
দেশে কোনো যুবক বেকার থাকবে না এবং কাউকে বেকার ভাতাও নিতে হবে না- এমন কর্মসংস্থানমুখী রাষ্ট্র গড়ার অঙ্গীকার করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘যুবকরা কারও কাছ থেকে বেকার ভাতা গ্রহণ করুক, তা আমরা দেখতেও চাই না, শুনতেও চাই না। আমরা প্রতিটি যুবকের হাতকে দেশ গড়ার কারিগরের হাতে পরিণত করতে চাই। প্রত্যেকটি হাতে কাজ তুলে দিতে চাই। বেকার ভাতা নয়, বেকার ভাতার পরিবর্তে এরাই দেশের সব ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করবে, সেই বিপ্লবের বাণী তাদের মুখে পৌঁছে দিতে চাই।’
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ‘কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলন-২০২৫’-এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি সাদ্দাম হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে জামায়াতের শীর্ষ নেতারাসহ দেশ-বিদেশের বরেণ্য অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। ডা. শফিকুর রহমান তার বক্তব্যে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট স্মরণ করে বলেন, ১৯৪৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত দীর্ঘ লড়াই ও ত্যাগের বিনিময়ে আজকের বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আব্দুল মালেক থেকে শুরু করে সর্বশেষ বিপ্লবী শরীফ উসমান হাদি পর্যন্ত অনেকের রক্তের কাছে আমরা ঋণী। ছাত্রশিবির এখন আর সাধারণ কোনো সংগঠন নয়; চব্বিশের বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ছাত্রসমাজ তাদের ভালোবাসার মাধ্যমে এই সংগঠনকে ছাত্রসমাজের অভিভাবকের দায়িত্ব দিয়েছে।’
গত ৫৪ বছরে ছাত্রদের হাতে কলমের বদলে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন জামায়াত আমির। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মিনি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত হয়েছিল, যেখানে মেয়েদের ইজ্জত বা ছাত্রদের ক্যারিয়ারের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। সেই কালো অধ্যায় বিদায় নিতে শুরু করলেও এর ছায়া এখনও রয়ে গেছে। এই কালো ছায়া পুরোপুরি দূর না হওয়া পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদক ও অস্ত্র নির্মূল করে শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে ‘পিতা-পুত্রের’ সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান তিনি।
তৃণমূল কর্মীদের উদ্দেশে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘তোমাদের কাঁধে অসংখ্য শহিদের লাশ এবং ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যাশার বোঝা। ইনসাফ কায়েমের লক্ষ্যেই ছাত্রসমাজ শিবিরকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছে। কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে একটি দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য তোমাদের দক্ষ কারিগর হিসেবে তৈরি হতে হবে।’
ছাত্রশিবির দুনিয়াকে আখেরাতের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে- পরওয়ার : রাজধানীর চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ছাত্রশিবির সেই প্রাণ, সেই সত্তা- তারা দুনিয়াকে আখেরাতের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে। তারা দ্বীনের জন্য জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারে।
ছাত্রশিবিরের সঙ্গে গোটা জাতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য ছাত্রশিবিরের এই যাত্রার পেছনে গোটা জাতি তাদের সাহায্য করবে। তারা দুনিয়ার স্বার্থ সম্পদ গাড়ি বাড়ি সম্মান বিক্রি করে দিয়েছে, দুনিয়ায় তাদের দাবিয়ে রাখা যাবে না।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ছাত্রশিবিরের আদর্শকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে একদল অপপ্রচার চালাচ্ছে। জাতি কোনো মিথ্যাচার বিশ্বাস করবে না। রাজনীতির ইতিহাসে এটা একটা মহাসত্য। ছাত্রশিবিরের আদর্শবাদী আন্দোলনকে যখন একদল শক্তি, যুক্তি ও আদর্শ দিয়ে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়, তারা তখন মিথ্যাচার আর অপপ্রচারের অন্ধকার পথ বেছে নেয়।
তিনি বলেন, ছাত্রশিবির হলো দুঃসাহসী নির্ভীক বিজয়ী বীর। অনেক আত্মত্যাগ, অনেক শাহাদাতের রক্তের বিনিময়ে আজকে আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি। একটা কালো যুগ আমাদের পেছনে ফেলে এসেছি। ঠিক যে সময়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে, ঠিক সেই সময় আবার একটি চক্রের ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছি। জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ছাত্রশিবির তথা আধিপত্যবাদবিরোধী ইসলামি জনতার সংগ্রামকে ঠেকাবার জন্য সন্ত্রাস দিয়ে যখন তারা পারেনি, তখন তারা মিথ্যাচার ও অপপ্রচার দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করে আমাদের আবার পেছনে ঢেলে দিতে চায়।
তিনি আরও বলেন, ছাত্রশিবিরকে স্বাধীনতাবিরোধী, রগকাটা ও গুপ্ত সংগঠন বলা হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে। চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করে প্রমাণ করেছে অসত্য ও মিথ্যা কথায় শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয়নি। যারা আল্লাহকে পাওয়ার জন্য জীবন বিলিয়ে দেয় তাদের খুন, ফাঁসি, রিমান্ড, আয়নাঘর ও ক্রসফায়ার দিয়ে দমিয়ে রাখা যাবে না- যোগ করেন মিয়া গোলাম পরওয়ার।
ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার অঙ্গীকার ছাত্রশিবিরের বিদায়ী সভাপতির : শহিদদের আত্মত্যাগের ধারাবাহিকতায় ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিদায়ী সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান তরুণ সমাজের মধ্যে যে আদর্শিক জাগরণ সৃষ্টি করেছে, তা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে। শুক্রবার রাজধানীর চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলন-২০২৫ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। জাহিদুল ইসলাম বলেন, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পরও দেশে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক বৈষম্যদূর হয়নি। বিশেষ করে ১৯৭১-৭৫ সময়ে একদলীয় শাসন, ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংকট গভীর হয়। সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের যাত্রা শুরু হয়। তিনি বলেন, আজাদির সংগ্রামে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এবং ১৯৭১ থেকে ২০২৪- প্রতিটি পর্যায়ে রাজনৈতিক পরিবর্তন এলেও অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাবে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ফ্যাসিস্ট শাসনামলে শেখ হাসিনা দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেন, নির্বাচনকে কারচুপির উৎসবে পরিণত করা হয় এবং তরুণদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ৭১-এর চেতনাকে ব্যবহার করে দীর্ঘ সময় মাফিয়াতন্ত্র, ব্যাংক লুট, গুম-খুন ও দমন-পীড়নের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে; ভিন্নমত ও প্রতিবাদ দমনে জেল-জুলুম ও বিচারিক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়, পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করা হয়।
ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি বলেন, পরিকল্পিতভাবে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে মানবিক সত্তাহীন হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয় এবং ‘শিবির মানেই হত্যাযোগ্য’- এমন ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি করা হয়। ‘ছাত্রশিবির’ ট্যাগ দিয়ে বহু সাধারণ শিক্ষার্থী নির্যাতন ও হত্যার শিকার হন। ২০১৩ সালে শাহবাগকে কেন্দ্র করে তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে ফ্যাসিবাদ আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়; হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের ওপর চালানো হয় দমন-পীড়ন এবং দাড়ি-টুপিকে জঙ্গিবাদের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে প্রশাসন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত ইসলাম ও ধর্মীয় মূল্যবোধ দমন করা হয়। এসবের প্রতিবাদেই ২০২৪ সালের জুলাইয়ে গণআন্দোলন বিস্ফোরিত হয় এবং শেখ হাসিনার শাসনের পতন ঘটে। তরুণদের আত্মত্যাগ নতুন আদর্শিক জাগরণ সৃষ্টি করে, যা ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দেয়।
তিনি বলেন, এমন এক সময়ে এই আয়োজন হচ্ছে- যখন ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলায় প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ মানুষ। এ পর্যন্ত ৭০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় দুই লাখ মানুষ আহত হয়েছেন, যাদের বড় অংশ নারী ও শিশু। একই সঙ্গে অবরোধ ও খাদ্যসংকটে হাজার হাজার মানুষ অনাহারের মুখে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছেন। শহিদদের আত্মত্যাগের ফলেই আজ উন্মুক্ত দাওয়াতি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তাদের রেখে যাওয়া দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করতে পারলে এর জবাবদিহি করতে হবে। তাই সব বাধা অতিক্রম করে আন্দোলনের গতি আরও জোরদার করার আহ্বান জানাচ্ছি। মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
শিবিরের নতুন সভাপতি সাদ্দাম, সেক্রেটারি জেনারেল সিবগাতুল্লাহ : বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে মনোনীত হয়েছেন নুরুল ইসলাম সাদ্দাম। আর নতুন সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে মনোনীত হয়েছেন সিবগাতুল্লাহ সিবগা। শুক্রবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব পান তারা। নুরুল ইসলাম সাদ্দাম এর আগে ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি সংগঠনটির কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। শিক্ষাজীবনে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত উদ্যোক্তা অর্থনীতিতে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্সে অধ্যয়নরত রয়েছেন।
অপরদিকে সিবগাতুল্লাহ ২০২৫ সেশনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের দপ্তর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন। পাশাপাশি সংগঠনের কেন্দ্রীয় শিক্ষা সম্পাদক, প্রকাশনা ও সাহিত্য সম্পাদকসহ আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদকীয় পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
উল্লেখ্য, গতকাল সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম সভাপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে ছাত্রশিবিরের সাংবিধানিক নীতি অনুযায়ী তিনি সিবগাতুল্লাহকে সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে মনোনীত করেন।