
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদি হত্যার বিচার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন তার সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও রয়েছেন। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর এই কর্মসূচি শুরু করে ইনকিলাব মঞ্চ। বিকেল ৪টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কর্মসূচি চলছিল। শহিদ ওসমান হাদি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মুখ। তিনি গত বছরের আগস্টে ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করেন। ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন তিনি। অনেক দিন ধরে তিনি গণসংযোগ করে আসছিলেন।
১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের কিছু পর রাজধানীর পুরানা পল্টনের কালভার্ট রোডে রিকশায় থাকা ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়। তাকে মাথায় গুলি করার পর আততায়ীরা মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানে ১৮ ডিসেম্বর মারা যান তিনি। গত রোববার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে তার জানাজা হয়। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদসংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিস্থলের পাশে দাফন করা হয়।
ওসমান হাদির খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি চালিয়ে আসছে ইনকিলাব মঞ্চ। পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ তারা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে।
শাহবাগ মোড় অবরোধে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা ‘আপস না বিপ্লব, বিপ্লব বিপ্লব’, ‘আমরা সবাই হাদি হব, যুগে যুগে লড়ে যাব’, ‘শাহবাগ না ইনসাফ, ইনসাফ ইনসাফ’, ‘এই দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘বিচার বিচার চাই, হাদি হত্যার বিচার চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিচ্ছেন।
কর্মসূচিতে ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের বলেন, বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথেই থাকবেন। এই অবরোধ চলছে, এই অবরোধ চলবে। বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা যাবেন না। আবদুল্লাহ আল জাবের বলেন, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ওসমান হাদির যে লড়াই ছিল, তা চলছে। ওসমান হাদিকে সামনে রেখে এই লড়াই চলবে। আবদুল্লাহ আল জাবের বলেন, ‘আমাদের যেই লড়াই, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখার, আমাদের সেই লড়াই চলবে।’
বিচার না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগ ছাড়ব না -আসাদুজ্জামান আসাদ : ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ওসমান হাদি হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগ মোড় অবরোধ করে অবস্থান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইনকিলাব মঞ্চের অন্যতম সংগঠক আসাদুজ্জামান আসাদ। তিনি বলেছেন, আমাদের এই অবস্থান এবং আন্দোলন কোনো অর্থ বা সুযোগ-সুবিধার জন্য নয়, বরং এটি শহিদের রক্তের ইনসাফ কায়েমের লড়াই। শহিদ ওসমান হাদির হত্যার বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না। গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীসহ সাধারণ শিক্ষার্থী-জনতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগে এসে অবস্থান নেয়। এ সময় তারা যান-চলাচল বন্ধ করে দেয়। আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, অসংখ্য মানুষ আমাদের হাতে অর্থ দিয়ে আন্দোলনকে সমর্থন জানাচ্ছেন, তবে আমাদের অর্থের কোন প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন আপনাদের সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এখানে স্পষ্ট লেখা আছে— জান দেব জুলাই দেব না।
শহিদ ওসমান হাদি নিজের জীবন দিয়ে এই আদর্শ প্রমাণ করেছেন, এখন সাধারণ মানুষের পালা এই দেশে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার। তিনি ঘোষণা করেন, ওসমানের খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রাখবেন। উপস্থিত জনতাকে শপথ করিয়ে বলেন, আজ সবাই প্রতিজ্ঞা করেন, যতক্ষণ আমাদের শরীফ ওসমান হাদির বিচার হবে না, আমরা কেউ ঘরে ফিরে যাব না। এক ফোঁটা পানিও পান করব না।
প্রধান আসামি ফয়সালকে ভারতে পালাতে সহযোগিতাকারী দুইজন কারাগারে : জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার সিভিয়ন ডিউ (৩২) ও সঞ্জয় চিসিমকে (২২) কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। দুই দফায় আটদিনের রিমান্ড শেষে গতকাল শুক্রবার তাদের ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ায় পর্যন্ত তাদের কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফয়সাল আহমেদ। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রিপন হোসেন তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এর আগে, গত ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলাম তাদের এ মামলায় তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপর গত ২১ ডিসেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সেফাতুল্লাহ তাদের দ্বিতীয় দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এই দুই আসামি এজাহার নামীয় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল দাউদ (৩৭) ও তার সহযোগী অজ্ঞাতনামা আসামিকে অবৈধ পথে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে বলে সাক্ষ্য-প্রমাণ ও প্রযুক্তি সহযোগিতায় তথ্য পাওয়া গেছে বলে রিমান্ড আবেদনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফয়সাল আহমেদ উল্লেখ করেছেন। আসামি সিভিয়ন ডিউ (৩২) হালুয়াঘাট-ধোবাউরা আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য জুয়েল আড়েং এর ভাগ্নে।
উল্লেখ, গত ১২ ডিসেম্বর দুপুর আনুমানিক ২টা ২০ মিনিটে রাজধানীর পল্টন থানাধীন বক্স কালভার্ট রোডে ওসমান হাদির ওপর দুষ্কৃতিকারীরা গুলি করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় গত ১৪ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের বাদী হয়ে পল্টন থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ১২০(বি)/৩২৬/৩০৭/ ১০৯/৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এরপর গত ২০ ডিসেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলায় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা (হত্যা) সংযোজনের আদেশ দেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্দিক আজাদ।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত ১২ ডিসেম্বর দুপুর আনুমানিক ২টা ২০ মিনিটে মতিঝিল মসজিদ থেকে জুমার নামাজের পর প্রচারণা শেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যাওয়ার পথে পল্টন থানাধীন বক্স কালভার্ট রোডের পাকা রাস্তার উপর শরিফ ওসমান হাদির পেছন থেকে অনুসরণ করে আসা মোটরসাইকেলে থাকা আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল দাউদ ও তার সহযোগী অজ্ঞাতনামা আসামি ওসমান হাদিকে চলন্ত অবস্থায় হত্যার উদ্দেশ্য আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে পালিয়ে যায়।
আহত শরিফ ওসমান হাদিকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরবর্তীতে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শারীরিক অবস্থা অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে গত ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি মারা যান।