১. জাকাত ব্যবস্থা : জাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি। এর মাধ্যমেই অনুমান করা যায়, ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব কত অপরিসীম। জাকাত শুধু ইবাদত নয়, বরং দারিদ্র্য বিমোচনের এক মহাশক্তিশালী হাতিয়ার। মূলত ধনী-গরিবের মধ্যকার অর্থনৈতিক পার্থক্য হ্রাস করা এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই ইসলামে জাকাতের বিধান দেয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাদের (ধনীদের) সম্পদে জাকাত ফরজ করেছেন, যা ধনীদের কাছ থেকে নেয়া হবে এবং গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।’ (বোখারি : ১৩৯৫)। আর এ জাকাত ধনীদের পক্ষ থেকে দরিদ্রদের জন্য দয়া বা অনুগ্রহ নয়, বরং এটা দরিদ্রদের প্রাপ্য অধিকার। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের সম্পদে রয়েছে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতের অধিকার।’ (সুরা যারিয়াত : ১৯)।
জাকাত না দেয়ার শাস্তি : জাকাত দরিদ্রদের প্রাপ্য অধিকার এবং এর মাধ্যমে যেহেতু তারা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে থাকে, তাই জাকাত ফরজ হওয়ার পরও যদি কেউ জাকাত না দেয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা স্বর্ণ ও রুপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন সে ধন-সম্পদ জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে, তারপর তা দ্বারা তাদের কপাল, তাদের পাঁজর ও পিঠে দাগ দেয়া হবে। (বলা হবে) এ হচ্ছে সেই সম্পদ, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যে সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে, তার শাস্তি ভোগ কর।’ (সুরা তাওবা : ৩৪-৩৫)।
জাকাতের উপকারিতা : জাকাতের ইহকালীন ও পরকালীন বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, জাকাত দেয়ার কারণে জাকাতদাতার সম্পদ? হ্রাস পায় না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দান-সদকা (জাকাত) কখনও সম্পদ কমায় না।’ (মুসলিম : ২৫৮৮)। এ ছাড়া জাকাত ধনী-গরিবের মধ্যে সৌহার্দ্য সৃষ্টি করে, সমাজের অপরাধপ্রবণতা হ্রাস করে এবং অর্থনীতিকে গতিশীল করে। তাই সঠিকভাবে জাকাতের কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠনে তা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
২. ঋণ পরিশোধে অবকাশ : ঋণগ্রস্ততা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং দারিদ্র্যের প্রধানতম কারণ। ঋণ পরিশোধে অবকাশ দরিদ্রদের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সহায়তা করে। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। তাই ইসলামের বিধান হলো, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি দরিদ্র হয়, তাহলে তার দারিদ্র্য বিমোচন হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে অবকাশ দিতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কোনো (ঋণগ্রহীতা) ব্যক্তি যদি অসচ্ছল হয়, তবে সচ্ছলতা লাভ করা পর্যন্ত (তাকে) অবকাশ দিতে হবে। আর যদি সদকা করে দাও, তবে তোমাদের পক্ষে সেটা অধিকতর শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি কর।’ (সুরা বাকারা : ২৮০)।
অবকাশ দেয়ার পুরস্কার : ইসলাম শুধু ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে ঋণ পরিশোধের অবকাশ দেয়ার বিধান দিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি, বরং যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধের অবকাশ দেবে, তার জন্য ঘোষণা করেছে মহাপুরস্কার। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অভাবীকে অবকাশ দেবে, তার জন্য ঋণ পরিশোধের সময় পর্যন্ত প্রতিদিন সদকার সওয়াব লেখা হবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৫/৩৬০)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তীদের মাঝে জনৈক ব্যক্তি ছিল। তার কাছে ফেরেশতা তার জান কবজ করার জন্য এসেছিলেন। এরপর (জান কবজের পরে) তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি কি কোনো ভালো কাজ করেছ? সে জবাব দিল, আমার জানা নেই।
তাকে বলা হলো, একটু চিন্তা করে দেখ। সে বলল, এ জিনিসটি ছাড়া আমার আর কিছুই জানা নেই যে, দুনিয়াতে আমি মানুষের সঙ্গে ব্যবসা করতাম। অর্থাৎ ঋণ দিতাম। আর তা আদায়ের জন্য তাদের তাগিদ দিতাম। আদায় করতে না পারলে, সচ্ছল ব্যক্তিকে সময় দিতাম আর অভাবী হলে ক্ষমা করে দিতাম। (এ আমলের কারণে) তখন আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালেন।’ (বোখারি : ৩৪৫১)।
৩. সাধারণ দান : দান-সদকা মানবিকতার এক মহৎ রূপ। এটি দারিদ্র্য বিমোচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দানের অর্থ দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি তাদের স্বাবলম্বী হয়ে উঠতেও সহায়তা করে। তাই জাকাত-ফেতরার পাশাপাশি ইসলাম মানুষকে সাধারণ দানের প্রতিও উদ্বুদ্ধ করে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলিমের ওপর দান-সদকা করা একান্ত জরুরি।’ (মুসলিম : ১০০৮)।
দানের উপকারিতা : দান-সদকা যে শুধু গ্রহীতার জন্যই উপকার ও কল্যাণ বয়ে আনে এমনটা নয়, বরং দাতার জন্য?ও বয়ে আনে অফুরন্ত কল্যাণ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ দিনে এবং রাতে, গোপনে এবং প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তাদের প্রতিদান তাদের রবের কাছে রয়েছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৭৪)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর সমপরিমাণ দান করে আর আল্লাহতায়ালা হালাল সম্পদ ছাড়া গ্রহণ করেন না, আল্লাহতায়ালা তা ডান হাতে গ্রহণ করেন। তারপর তা দাতার কল্যাণার্থে প্রতিপালন করেন, যেমন তোমাদের কেউ অশ্বশাবক প্রতিপালন করে থাকে। অবশেষে সেই দান পাহাড় সমপরিমাণ হয়ে যায়।’ (বোখারি : ১৪১০)।
৪. শস্য-ফসল উৎপাদন : ইসলাম মানুষকে শস্য-ফসল উৎপাদন করার জন্য জোর তাগিদ দেয়। কারণ, শস্য-ফসল উৎপাদন শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই নিশ্চিত করে না, বরং অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে এবং সর্বোপরি দারিদ্র্য বিমোচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যার জমি আছে, সে যেন নিজেই তা চাষ করে। যদি নিজে চাষ করতে না পারে, তাহলে (পতিত না রেখে) কোনো প্রতিদান ছাড়াই যেন অপর ভাইকে তা দান করে।’ (মুসলিম : ৩৭৭৬)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘কেয়ামত কায়েম হয়ে গেলেও, তোমাদের কারো হাতে যদি কোনো গাছের চারা থাকে এবং সে তা এর আগেই রোপন করতে সক্ষম হয়, তবে যেন সে তা রোপন করে ফেলে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১২৯৮১, সহিহুল জামে : ১৪২৪)। এমনকি বৃক্ষরোপন ও শস্য-ফসল ফলানোকে ইসলাম ইবাদতের মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলিম যদি বৃক্ষরোপণ করে কিংবা ফসল উৎপাদন করে, আর তা থেকে পাখি, মানুষ কিংবা চতুষ্পদ জন্তু কিছু খায়, তবে তা তার পক্ষ থেকে সদকা হবে।’ (মুসলিম : ১৫৫৩, মুসনাদে আহমদ : ১২৪৯৭)।
৫. ব্যবসা-বাণিজ্য করা : জীবিকার পবিত্র ও সম্মানজনক মাধ্যম হলো ব্যবসা। ব্যবসা মানুষকে সৎ ও পরিশ্রমী হতে শেখায়। মুক্তি দেয় আর্থিক অনিশ্চয়তা থেকে। বিকশিত করে উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও সৃজনশীলতা। সৃষ্টি করে কর্মসংস্থান। ব্যক্তিকে করে দক্ষ, যুগ সচেতন, নেতৃত্ব জ্ঞানসম্পন্ন এবং আত্মবিশ্বাসী। এভাবেই বৃহৎ পরিসরে দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যম হয়ে ওঠে ব্যবসা। এ সকল কারণেই ইসলাম মানুষকে ব্যবসা করতে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নামাজ শেষ হয়ে গেলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ (ব্যবসা-বাণিজ্য) কর। আর বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।’ (সুরা জুমা : ১০)।
ইসলামে ব্যবসার অবস্থান : ইসলাম ব্যবসাকে স্থান দিয়েছে অন্যান্য উচ্চতায়। রাসুল (সা.)-কে একবার প্রশ্ন করা হলো, ‘কোন ধরনের উপার্জন উত্তম ও শ্রেষ্ঠ?’ তিনি বলেন, ‘মানুষের নিজ হাতে করা কাজ এবং সৎ ব্যবসা।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭২৬৫, মুসনাদে বাজ্জার : ৭৮৪)। ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেন, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক এবং শহিদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি : ১২০৯)।
রাসুল (সা.)-এর ব্যবসা : রাসুল (সা.) এবং তার বহু সাহাবি ব্যবসাকে উপার্জনের সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি রাসুল (সা.) যৌথ ব্যবসাও করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব (রা.) বলেন, আমি জাহেলি যুগে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ব্যবসায় অংশীদার ছিলাম। যখন আমি মদিনায় গেলাম, তখন তিনি বললেন, ‘আমাকে চিনেছেন?’ আমি বললাম, ‘কেন চিনব না? আপনি তো আমার ব্যবসার ভালো একজন অংশীদার ছিলেন। না কোনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন, না কোনো কিছু নিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করেছেন!’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ২/৪৮০)।
লেখক : ইমাম ও খতিব, ফুকুরহাটি মধ্যপাড়া জামে মসজিদ, ভাঙ্গা, ফরিদপুর