ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতি হলো বর্তমান বিশ্বে একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগজনক প্রবণতা। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক ভয়, বিদ্বেষ ও বৈষম্যমূলক আচরণ। এটি শুধু ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা নয়, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক। গণমাধ্যমে যা আজ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। এটি শুধু কোনো ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে ভয় বা বিরূপ মনোভাবই নয়, বরং মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ, বৈষম্য ও সহিংস আচরণ। এ বিদ্বেষমূলক মানসিকতা বৈশ্বিক শান্তি ও সহনশীলতার পরিপন্থি এবং একটি সভ্যসমাজের জন্য চরম হুমকি। নাইন ইলেভেনের পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া ব্যাপক হারে বেড়েছে। ইসলামোফোবিয়া শুধু একটি ধর্মীয় বিদ্বেষ নয়, বরং এটি সুপরিকল্পিত গভীর ফাঁদ। সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা, যা গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী একটি সংগঠিত রূপ লাভ করেছে। এটি এখন বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে মুসলমানরা এখন কোনো না কোনোভাবে বৈষম্য, কুসংস্কার বা নিপীড়নের শিকার। পশ্চিমা বিশ্বে এটি ‘ইসলামোফোবিয়া’ নামে চিহ্নিত হলেও বাস্তবে এটি শুধু ভয় নয়; বরং ঘৃণা, বর্ণবাদ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মহারূপ।
গণমাধ্যমে বিকৃত উপস্থাপনা : মিডিয়া ও ইসলামের নেতিবাচক চিত্রায়ন হয়ে উঠেছে পশ্চিমাবাদীদের পেশা ও নেশা। উদাহরণত পশ্চিমা মিডিয়ায় মুসলমানদের প্রায়ই সন্ত্রাসী, নিপীড়ক বা অসহিষ্ণু, জঙ্গি, উগ্রবাদী, নারী নির্যাতক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকান নিউজ কভারেজে মুসলমানদের ৮০ শতাংশ নেতিবাচকভাবে দেখানো হয়। তদ্রূপ হলিউড সিনেমাগুলোতে মুসলিম চরিত্রগুলোকে প্রায়ই হিংস্র হিসেবে ফুটিয়ে তোলার নিকৃষ্ট প্রতিযোগিতা রয়েছে।
রাজনৈতিক অপ-প্রচার ও পপুলিজম : অনেক রাজনীতিবিদ ভোটের জন্য মুসলিমবিরোধী বক্তব্য ব্যবহার করেন। ইউরোপের ডানপন্থি দলগুলো (যেমন- ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্ট) ইসলামকে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে। ঘৃণাপূর্ণ রাজনৈতিক প্রচারণায় অনেক দেশেই ইসলামবিদ্বেষী রাজনীতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ইউরোপ ও আমেরিকা। তারা তাদের প্রচারণায় মুসলিমবিদ্বেষকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে থাকে।
জিহাদকে সন্ত্রাসবাদ ও ভুল ব্যাখ্যা : বিশ্বজুড়ে ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার বড় কারণ হলো, তথাকথিত ‘জিহাদি সন্ত্রাসবাদ’; যা ইসলামের একটি বিকৃত ব্যাখ্যার ফসল। সত্য বা অসত্য ঘটনাকে পশ্চিমারা মিথ্যার লেবাস পরিয়ে জাতির মেধা ও মননে গেঁথে দিয়েছে অরাজক ভীতি। অথচ প্রকৃত ইসলাম সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে ঘৃণা করে এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। আবার অনেকেই ইসলামের সঠিক বার্তা না জেনে, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতস্বরে অথবা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে সন্ত্রাসের সঙ্গে ইসলামকে যুক্ত করে।
রাষ্ট্রীয় ইসলামোফোবিয়া : ইসলামোফোবিয়া শুধু ব্যক্তি-মানসিকতার সীমাবদ্ধ বিকৃতি নয়, এটি ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের আইন, নীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় রূপ নিচ্ছে। ইসলামোফোবিয়ার প্রসারে রাষ্ট্রীয় বৈষম্য একপ্রকার সাংবিধানিক জুলুম; যা সুশীলতার মুখোশ পরে মুসলমানদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। এক সময় যা কেবল ঘৃণা-ভাষণে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ তা অনেক দেশের সংবিধান ও সরকারি আচরণে পরিণত হয়েছে। এটিই রাষ্ট্রীয় ইসলামোফোবিয়া। যেমন- ফ্রান্সে হিজাব নিষিদ্ধকরণ, ভারতে মুসলিমবিরোধী নাগরিকত্ব আইন, চীনে উইঘুর মুসলমানদের বন্দিশিবিরে আটকে রাখা। এগুলো রাষ্ট্রীয় ইসলামোফোবিয়ার অন্যতম উদাহরণ।
হিংসাত্মক হামলা ও ঘৃণাপূর্ণ আচরণ : ইসলামোফোবিয়া যখন নিছক অপমানসূচক শব্দ, রাজনৈতিক প্রচার বা আইনগত বৈষম্যের পর্যায় অতিক্রম করে, তখন তা রূপ নেয় প্রাণঘাতী ঘৃণায়; যা মানুষকে অস্ত্রধারী করে তোলে, মসজিদকে রক্তাক্ত করে, আর নিরীহ মুসলিম পরিবারকে কবরগাত্রে ঠেলে দেয়। বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার ভিত্তিতে সংঘটিত সহিংস হামলাগুলো বিশ্ব বিবেককে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যেমন- নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় ৫১ মুসল্লির মর্মান্তিক মৃত্যু, ভারতে গো-রক্ষার নামে নিত্যদিন মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা ইত্যাদি।
ইসলামোফোবিয়া মোকাবিলায় করণীয়
১. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি : শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনসাধারণের ভুল ভাঙানো। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইসলাম সম্পর্কে তথ্যনির্ভর পাঠপুস্তক অন্তর্ভুক্ত করা। সমাজে ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরা। ইসলামি ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শনে মুসলমানদের অবদান প্রচার করা। গণমাধ্যমবিষয়ে সতর্ক করা; যাতে মানুষ প্রোপাগান্ডা ও তথ্যবিকৃতিকে চিহ্নিত করতে পারে। এককথায়, ইসলামের সঠিক বার্তা প্রচার, শান্তি, সহিষ্ণুতা ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা তুলে ধরা।
২. সত্য ও তথ্যভিত্তিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠা : ইসলামি স্কলারদের মিডিয়ায় অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি। নিজস্ব টিভি, জাতীয় পত্রিকা, অনলাইন চ্যানেল, প্রামাণ্যচিত্র প্রোডাকশন বাড়ানো। তথ্যপ্রযুক্তি ও মিডিয়ায় মুসলমানদের নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। মিডিয়ার প্রভাব বোঝা ও সাংবাদিকতা, ইসলামি কন্টেন্ট, সুসাহিত্য, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে সক্রিয় হওয়া জরুরি। সহজ কথায়, মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেশন উন্নত করা। ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মানুষদের সাংবাদিকতা, লেখালেখি ও সমাজকল্যাণমূলক কাজের প্রতি উৎসাহিত করা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমানুষের আগ্রহের জায়গাগুলোতে ইসলাম সম্পর্কে তথ্যনির্ভর ডকুমেন্টারি ও ইতিবাচক গল্প প্রকাশ করা।
৩. আইনি পদক্ষেপ ও অধিকার সুরক্ষা : ইসলামবিদ্বেষী আইন ও নীতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে চাপ তৈরি। ঘৃণাজনিত অপরাধের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি। ওআইসি, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মাধ্যমে প্রতিবাদ ও পদক্ষেপ গ্রহণ। গ্লোবাল মুসলিম অর্গানাইজেশন বা ওআইসিসহ মুসলিম দেশগুলোর সম্মিলিত কূটনৈতিক চাপ ও বার্তা দিতে হবে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে। মোটকথা, ঘৃণাজনিত অপরাধের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য অ্যান্টি-ডিসক্রিমিনেশন লজিক (বৈষম্যবিরোধী যুক্তি বা তর্কতাত্ত্বিক ভিত্তি) কার্যকর করা।
৪. দাওয়াহ ও মানবিক কার্যক্রমের প্রসার : ইসলামোফোবিয়া আজ শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষে সীমাবদ্ধ নেই, বরং একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। মুসলমানদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার, ধর্মীয় পোশাক বা চর্চাকে ভয়ভীতির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন এবং সহিংসতার সঙ্গে ইসলামকে একত্র করার অপচেষ্টা- এসবই এ প্রবণতাকে তীব্র করে তুলেছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসূ পথ হতে পারে দাওয়াহ ও মানবিক কার্যক্রমের প্রসার। যেমন- গরিব-অসহায়দের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, দরিদ্র শিশুদের নির্মূল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্বেচ্ছাসেবী ত্রাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, অমুসলিম প্রতিবেশীদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও সহমর্মিতা প্রকাশ ইত্যাদি।
শেষকথা : ইসলামোফোবিয়া একটি পরিকল্পিত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিদ্বেষের ফল; যা এমন এক জটিল সামাজিক সমস্যা, যা কেবল মুসলমানদের নয়, সমগ্র মানবতার জন্য ক্ষতিকর। এর মোকাবিলায় শিক্ষাব্যবস্থা, মিডিয়া সংস্কার, আইনি সুরক্ষা ও সামাজিক সংহতি প্রয়োজন। এর বিরুদ্ধে লড়াই কেবল প্রতিক্রিয়া নয়; বরং একটি চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার সঠিক প্রচারের মাধ্যমেই ইসলামোফোবিয়ার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলা সম্ভব। সত্য, ন্যায় ও সহনশীলতার বার্তাকে সামনে রেখে আমরা যদি সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসি, তাহলে শুধু মুসলমানদের নিরাপত্তা নয়, সমগ্র মানবতার মঙ্গল নিশ্চিত হবে।