প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫
পবিত্র কোরআনে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসাকে আল্লাহর নির্দশন বলে গণ্য করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদেরকে সৃষ্টি করেছেন; যেন তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।’ (সুরা রুম : ২১)। স্ত্রীকে ভালোবাসা যেমন সুখের জন্য জরুরি, ভালোবাসা প্রকাশ করাটাও সুখের সৌন্দর্য। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রেমিক পুরুষ ছিলেন আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.)। স্ত্রীদের প্রতি ভালোবাসার কথা তিনি কথায়-আচরণে প্রকাশ করেছেন। প্রত্যেক স্বামীর জন্য তার জীবনই উত্তম আদর্শ। তিনি বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম আচরণ কর।’ (তিরমিজি : ১১৬৩)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর কাছে সর্বোত্তম। আর স্ত্রীদের সঙ্গে আচার-ব্যবহারে আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম।’ (তিরমিজি : ৪০৬২)। রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীদের সঙ্গে তার ভালোবাসার কিছু নমুনা তুলে ধরা হলো-
স্ত্রীর সঙ্গে রোমাঞ্চকর কথা : রাসুল (সা.) বিভিন্ন সময়ে তার প্রিয়তমা স্ত্রীদেরকে রোমাঞ্চকর কথা বলে আপ্লুত করতেন। যেমন- খাদিজা (রা.) সম্পর্কে বলতেন, ‘আমার হৃদয়ে তার প্রতি ভালোবাসা ঢেলে দেওয়া হয়েছে।’ (মুসলিম : ২৪৩৫)। আয়েশা (রা.)-এর প্রশংসা করে রাসুল (সা.) বলতেন, ‘খাবারের মধ্যে সারিদ যেমন সেরা, নারীদের মধ্যে আয়েশাও তেমনি সবার সেরা।’ (বোখারি : ৩৪১১)।
স্ত্রীর প্রশংসা করা : একবার রাসুল (সা.) মুহাজিরদের মাঝে গনিমতের মাল বণ্টন করছিলেন। তখন যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.) তাকে কিছু বললেন। ওমর (রা.) রাসুল (সা.)-এর অসুবিধা হবে ভেবে রেগে গেলেন। রাসুল (সা.) সঙ্গে সঙ্গে ওমর (রা.)-কে নিষেধ করলেন। এরপর যয়নাব (রা.)-এর প্রশংসা করে বললেন, ‘সে একজন বড় আবেদা ও জাহেদা নারী।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/২১৭)।
অন্যের সামনেও স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ : আমর ইবনুল আস (রা.) রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কাছে সবার চেয়ে প্রিয় কে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আয়েশা।’ (বোখারি : ৩৬৬২)।
ভালোবেসে স্ত্রীকে ভিন্ন নামে ডাকা : আয়েশা (রা.) বলেন, কিছু হাবশি বালক মসজিদে খেলাধুলা করছিল। রাসুল (সা.) আমাকে ডেকে বললেন, ‘হুমায়রা! তুমি কি তাদের খেলাধুলা দেখতে চাও?’ (আস-সুনানুল কোবরা : ৮৯৫১)। রাসুল (সা.) আয়েশা (রা.)-কে ‘উম্মে আবদুল্লাহ’ উপনামেও ডাকতেন। অথচ আয়েশা (রা.)-এর গর্ভে তার কোনো সন্তান ছিল না। (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৭১১৭)।
স্ত্রীকে গল্প শোনানো ও শোনা : রাসুল (সা.) সুযোগ পেলেই স্ত্রীদের গল্প শোনাতেন। এ ক্ষেত্রে ‘উম্মে যরা’র গল্পটি বিখ্যাত। রাসুল (সা.) নিজেও গল্প শুনতেন। আয়েশা (রা.) একবার আরবের এগারো সহোদরার একটি দীর্ঘ কাহিনি রাসুল (সা.)-কে শোনান। রাসুল (সা.) তা ধৈর্য ধরে শোনেন। (সিরাতে আয়েশা : ৫৪-৫৫)।
স্ত্রীকে খুশি রাখার চেষ্টা করা : রাসুল (সা.) রোজ প্রত্যেক স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। একদিন এক স্ত্রীর ঘরে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি দেরি হয়ে গেল। আয়েশা (রা.) খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, সেই স্ত্রীকে কেউ এক বোতল মধু হাদিয়া দিয়েছে। তিনি রাসুল (সা.)-কে মধু পান করতে দেন বলে দেরি হলো। আয়েশা (রা.) ও হাফসা (রা.) পরিকল্পনা করে ভিন্ন ভিন্নভাবে রাসুল (সা.)-কে বললেন, ‘আপনার মুখ থেকে মাগাফিরের গন্ধ আসছে।’ (মাগাফির হলো, গন্ধ জাতীয় উদ্ভিদের ফুল)। এরপর রাসুল (সা.) আবার মধু পরিবেশনকারী স্ত্রীর ঘরে গেলে মধু পান করতে অস্বীকৃতি জানান। (বোখারি : ৬/১৯৫-১৯৬)।
বিপদাপদে স্ত্রীকে সান্ত¡না দেওয়া : সাফিয়্যা (রা.) কোনো এক সফরে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন। তিনি যে উটে আরোহন করেছিলেন, তা অত্যন্ত ধীর গতির হওয়ায় কাঁদতে লাগলেন। এ অবস্থা দেখে রাসুল (সা.) তার কাছে গেলেন। নিজ হাতে তার চোখের পানি মুছে তাকে সান্ত¦না দিলেন। (সুনানে নাসায়ি : ৯১১৭)।
ঘরোয়া কাজে স্ত্রীকে সহযোগিতা : আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) ঘরের লোকদেরকে তাদের কাজে সহযোগিতা করতেন।’ (বোখারি : ৬৭৬)।
ব্যক্তিগত কাজে স্ত্রীর মতামত নেওয়া : হোদায়বিয়ার সন্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটে রাসুল (সা.) উম্মে সালামা (রা.)-এর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময় যা অতি কার্যকরী বলে বিবেচিত হয়। (বোখারি : ২৭৩১)।
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া : স্ত্রীদেরকে সফরে নিয়ে যেতে রাসুল (সা.) লটারি করতেন। যার নাম আসত, তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতেন। (বোখারি : ২৫৯৩)।
স্ত্রীকে বিনোদনের সুযোগ করে দেওয়া : আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর সামনেই আমি পুতুল বানিয়ে খেলতাম। আমার বান্ধবীরাও আমার সঙ্গে খেলা করত। রাসুল (সা.) ঘরে প্রবেশ করলে তারা দৌড়ে পালাত। তখন তিনি তাদের ডেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন।’ (বোখারি : ৬১৩০)। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘একবার রাসুল (সা.) আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিলেন, আর আমি হাবশিদের খেলা দেখছিলাম। মসজিদের কাছে তারা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে খেলা করছিল।’ (বোখারি : ৩৫৩০)।
নিজেও বিনোদনে শরিক হওয়া : আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) এবং আমি দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম। আমি বিজয়ী হলাম। এরপর যখন আমি আরেকটু বড় হলাম, তখন আবার প্রতিযোগিতা করলাম। এবার রাসুল (সা.) বিজয়ী হলেন। বললেন, ‘এটা প্রথম প্রতিযোগিতায় তুমি জিতে যাওয়ার বদলা।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২২১৪)।
এক মেসওয়াকে দুজনে অংশ নেওয়া : আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) মেসওয়াক করে তা ধোয়ার জন্য আমাকে দিতেন। আমি নিজে প্রথমে তা দিয়ে মেসওয়াক করতাম, এরপর সেটা ধুয়ে তাকে দিতাম।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫২)।
একসঙ্গে গোসল করা : রাসুল (সা.) মায়মুনা (রা.) ও আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে একই মগে একই পাত্রের পানি দিয়ে পবিত্রতার গোসল করতেন। (সুনানে নাসায়ি : ৩৮০; মুসলিম : ৬২০)।
স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে শোয়া : আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমার হায়েজ অবস্থায় আমার কোলে মাথা রেখে রাসুল (সা.) কোরআন তেলাওয়াত করতেন।’ (সুনানে নাসায়ি : ১৩০; বোখারি : ২৯৭)।
স্ত্রীকে চুমু খাওয়া : আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) রোজা অবস্থায়ও চুমু খেতেন এবং শরীরের সঙ্গে শরীর লাগাতেন।’ (মুসলিম : ২/৭৭৭)।
স্ত্রীর কাছ থেকে চুল আঁচড়ে নেওয়া : আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) যখন এতেকাফ করতেন, তখন আমার দিকে তার মাথা ঝুঁকিয়ে দিতেন। আমি তার চুল আঁচড়ে দিতাম।’ (মুসলিম : ৫৭১)।
স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দেওয়া : রাসুল (সা.) বলেন, ‘স্ত্রীকে খাবার খাইয়ে দিলে তা সদকা হিসেবে কবুল হয় এবং তার প্রতিদান রয়েছে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৮৬৪)।
স্ত্রীর মুখের খাবার খাওয়া : আয়েশা (রা.) হাড্ডিযুক্ত গোশত খাওয়ার পর রাসুল (সা.) সেই হাড্ডি চুষে খেতেন। (মুসলিম : ৫৭৯)।
স্ত্রীর মুখে মুখ লাগিয়ে পান করা : আয়েশা (রা.) বলেন, ‘পাত্রের যে অংশে আমি মুখ রেখে পানি পান করতাম, রাসুল (সা.) সেখানেই মুখ লাগিয়ে পানি পান করতে পছন্দ করতেন।’ (মুসলিম : ৩০০)।
স্ত্রীর রাগ-অভিমান ও মন বোঝা : একবার রাসুল (সা.) বললেন, ‘আয়েশা! তুমি আমার ওপর রেগে থাকলে আমি বুঝতে পারি।’ আয়েশা (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! কিভাবে বোঝেন আপনি?’ রাসুল (সা.) বললেন, তুমি যখন আমার ওপর রেগে থাক, তখন ‘হে ইবরাহিম (আ.)-এর রব!’ বলে আল্লাহকে ডাকো; আর যখন খোশ-মেজাজে থাক, তখন ‘হে মুহাম্মদ (সা.)-এর রব!’ বলে আল্লাহকে ডাকো। (বোখারি : ৫২২৮)।
হায়েজের সময়ও স্ত্রীর পাশে থাকা : আয়েশা (রা.) হায়েজ অবস্থায় থাকলেও রাসুল (সা.) তার শরীরে হেলান দিয়ে বসতেন। কখনও কখনও মসজিদে নববির জানালা দিয়ে তিনি মাথাটা আয়েশা (রা.)-এর কক্ষের দিকে বাড়িয়ে দিতেন। (ফাতহুর রব্বানি : ১৬/২৩৮)।
ঋতুবতী অবস্থায় স্ত্রীকে ঘৃণা না করা : আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি ঋতুবতী অবস্থায় পানি পান করে রাসুল (সা.)-কে অবশিষ্ট পানি পান করতে দিতাম। আমি যেখানে মুখ লাগিয়ে পান করতাম, তিনিও পাত্রের সেই স্থানে মুখ লাগিয়ে পান করতেন।’ (মুসলিম : ৫৭৯)।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী