প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫
শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। শত্রুতায় কখনও সে ক্লান্ত হয় না। আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে লড়াইয়ে সে অলসতা করে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় শয়তান তোমদের শত্রু, তাকে তোমরা শত্রুই গণ্য করো।’ (সুরা ফাতির : ৬০)। সে সর্বাত্মক প্রচেষ্টাসহ আমাদের সঙ্গে অবিরাম শত্রুতা চালিয়ে যায়। অতএব, আমাদেরও সারাক্ষণ আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে তার সঙ্গে লড়াই করতে হবে, তার চক্রান্ত থেকে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করতে হবে। আমরা যেন তাদের মতো না হই, যাদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শয়তান তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে, ফলে সে তাদের আল্লাহর জিকির ভুলিয়ে দিয়েছে। তারাই হলো শয়তাদের দল। শুনে রাখো! নিশ্চয় শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সুরা মুজাদালা : ১৯)।
নৈরাশ্য শয়তানের চক্রান্ত : একটি সূক্ষ্ম বিষয় এমন আছে, যার প্রতি অনেকে লক্ষ্য করে না, বরং তা শয়তানের ঘৃণ্যতম ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত ভাবা হয়। তা হলো, শয়তান মানুষকে শুধু হারামে লিপ্ত করেই ক্ষান্ত হয় না; তাকে দিয়ে ওয়াজিবও তরক করিয়ে ছাড়ে। কারণ, বান্দা অনেক সময় গোনাহ করতে করতে তওবা কবুল হওয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়ে। মনে করে, তার ভালো হওয়ার বুঝি আর সুযোগ নেই। এটি তাকে আরও গোনাহ করতে প্ররোচিত করে। সে মনে করতে থাকে, গোনাহ অব্যাহত রেখে তওবা করার কোনো অবকাশ নেই। এর মাঝে সে ফরজ, ওয়াজিব ছেড়ে দেওয়ারও একটা বৈধতা খুঁজে পায়। শয়তান তার কাছে দলিল নিয়ে হাজির হয়, ‘আমার মতো এমন পাপী কী করে নামাজ-রোজা করতে পারে? কীভাবে সে মানুষকে উপদেশ দিতে পারে, সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতে পারে? আমার জন্য কী করে ভালো কাজের সুযোগ অবশিষ্ট থাকতে পারে?’ শয়তান এভাবে তাকে দ্বীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা ও ফরজ ওয়াজিব ত্যাগ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করে! এর চেয়ে বড় চক্রান্ত আর কী হতে পারে? গোনাহগারের করণীয় সম্পর্কে উদাসীন ব্যক্তিরাই এমন চক্রান্তের শিকার হয়। গোনাহ হলে তওবা করতে হবে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে; এমনটিই আল্লাহ বলেছেন, ‘দিবসের দুই প্রান্তভাগে ও রাতের প্রথমাংশে নামাজ কায়েম করো। নিশ্চয় সৎকর্ম অসৎকর্মকে মিটিয়ে দেয়। এটি উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য উপদেশ।’ (সুরা হুদ : ১১৪)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা গোনাহ না করলে, আল্লাহ তোমাদের পৃথিবী থেকে নিয়ে যাবেন; আর সৃষ্টি করবেন এমন এক সম্প্রদায়, যারা গোনাহ করবে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে; এরপর আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন।’ (মুসলিম : ২৭৪৯)।
নৈরাশ্য থেকে সতর্কতা : শয়তান কখনও সফল হয়ে গেলে, কাউকে পদস্খলিত করে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর নির্দেশনার ওপর আমল করা উচিত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘গোনাহ হয়ে গেলে পরপরই নেককাজ করো; এটি গোনাহকে মিটিয়ে দেবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ২১৩৫৪)। তওবার পর আবার গোনাহ হয়ে গেলে, আবার তওবা করতে হবে। তওবা গোনাহের সফল প্রতিষেধক। শয়তানকে কখনও নিজের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে দেওয়া যাবে না। গোনাহের পর তওবা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। শয়তান যেন তওবা থেকে বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। নিজের জন্য আল্লাহর আনুগত্যের মজবুত পথ নির্মাণ করে নিতে হবে। গোনাহ যেন এ পথকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে। কুপ্রবৃত্তি যতই প্রবল হোক, প্রতিদিনের নির্ধারিত আমল যেন চলতে থাকে। কোরআন তেলাওয়াত, নামাজ, জিকির, দোয়া- এগুলো লাগাতার করে যেতে হবে। এসব আমল ঈমানের খোরাক, বান্দার জন্য সুরক্ষিত দুর্গ।
একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করা যাক- কেউ জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়ে তৎপর। নিয়মিত তেলাওয়াত করে, জিকির করে; সে একটা গোনাহ করে বসল। এটি যেন তাকে অভ্যাসমতো চলতে থাকা আমল থেকে দূরে না সরিয়ে দেয়। খুব সতর্ক থাকতে হবে। কারও অবস্থা যেন নিম্নগামী না হয়। গোনাহ আগে গোপনে করত, এখন যেন প্রকাশ্যে করার সাহস না করে। আগে যে পাপটি দু’একবার হতো, এখন যেন সেটি বারবার না হতে থাকে। কেউ আগে সগিরা গোনাহ করত, এখন যেন সে কবিরা গোনাহের দিকে ধাবিত না হয়। কেউ কবিরা গোনাহ করত, এটি যেন তাকে গোনাহ সম্পর্কে বেপরোয়া করে না তোলে, সে যেন আল্লাহর যে কোনো আদেশ লঙ্ঘনে সাহসী না হয়ে ওঠে (আল্লাহ হেফাজত করুন)।
শয়তান যেন কাউকে বন্দি করে না ফেলে : শয়তান যেন কাউকে বন্দি করে না ফেলে। শয়তানকে সুযোগ দেওয়া যাবে না। সে যেন কল্যাণকর কাজে বাধা দিতে না পারে। গোনাহ যেন আত্মসংশোধনে প্রতিবন্ধক না হয়। গোনাহের ক্ষতি যেন নেককাজের মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া যায়। কিছু মানুষ এমন আছে, যাদের কোনো গোনাহ করতে নিষেধ করলে, শোনে না। তাদের অজুহাত হলো, আমি তো আরও অনেক গোনাহ করি, যা এ উপদেশদাতা জানে না; আমি শুধু এ একটি গোনাহ ছাড়লে কী লাভ? এটি বড় ধরনের ভুল। প্রতিটি গোনাহের জন্যই বিশেষ তওবা আছে। একটি গোনাহ থেকে তওবা, অন্য সব গোনাহ থেকে তওবার ওপর মওকুফ থাকতে পারে না। শয়তানের চক্রান্তে বুদ্ধিমানের পা দেওয়া অনুচিত। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না।
মানবচরিত্র প্রকৃতিগতভাবে ভালো কাজের দিকে ধাবমান। ভালো কাজ করতে পারলে সে আনন্দিত হয়। মন্দ কাজ অপছন্দ করে। মন্দ কাজ হয়ে গেলে সে অনুতপ্ত হয়, ব্যথিত হয়। সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার মাঝেই সে নিজের অস্তিত্বের স্থায়িত্ব ও জীবনের সুস্থতা কল্পনা করে। এক ব্যক্তি ওমর ইবনুল খাত্তার (রা.)-এর কাছে আসত। একসময় দেখা গেল, সে আর আসছে না। ওমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘অমুককে এখন আর দেখি না যে?’ লোকেরা বলল, ‘হে আমিরুল মোমিনিন! সে এখন মদে বুঁদ হয়ে থাকে।’ ওমর (রা.) নিজের মুনশিকে ডেকে বললেন, ‘লেখ- ওমর ইবনুল খাত্তাবের পক্ষ থেকে অমুকের পুত্র অমুকের কাছে। আল্লাহ তোমার ওপর শান্তি বর্ষণ করুন। হামদ ও সালাতের পর, আমি তোমার কাছে সেই আল্লাহর প্রশংসা করছি, যিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। যিনি পাপ ক্ষমা করেন, তওবা কবুল করেন, যিনি শাস্তি দানে কঠোর, শক্তিশালী। তিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। সবাইকে তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।’ এরপর ওমর (রা.) তার সঙ্গীদের বললেন, ‘তোমাদের ভাইয়ের জন্য দোয়া করো, সে যেন চিঠিটি আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে, আল্লাহ যেন তার তওবা কবুল করেন।’ লোকটির কাছে চিঠি পৌঁছাতেই সে এটি পড়তে শুরু করল এবং বারবার পড়তে থাকল। একপর্যায়ে বলল, ‘(আমার রব) গোনাহ ক্ষমা করেন, তওবা কবুল করেন, তিনি শাস্তি দানে কঠোর, আমাকে শাস্তির ভয় যেমন দেখিয়েছেন, আবার ক্ষমারও ওয়াদা করেছন।’ সে আপন মনে এগুলো বলে যাচ্ছিল আর খুব করে কাঁদছিল। এরপর সে উত্তমরূপে তওবা করল। আল্লাহতায়ালা তার তওবা কবুল করলেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির)।
সুযোগ থাকতে তওবা করুন : শয়তান ধোঁকাবাজ শত্রু। বারবার গোনাহ করার পর সে আরও এক বড় গোনাহে লিপ্ত করতে চায়; সেটি হলো নৈরাশ্যের গোনাহ, আল্লাহর ব্যাপারে মন্দ ধারণার গোনাহ। এটি তার অন্যান্য গোনাহের থেকেও অনেক বড় গোনাহ। এর প্রতিরোধে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়ার ব্যাপারে কোরআনে কারিমে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আনুগত্যশীল সুপথপ্রাপ্ত বান্দার জন্য অন্য কাউকে গোনাহের কারণে লজ্জিত করা খুবই নিকৃষ্ট কাজ। এক হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আল্লাহ অমুককে ক্ষমা করবেন না।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কে আমার নামে ক্ষমা করব না- এ বলে শপথ করে? আমি অমুককে ক্ষমা করে দিলাম। আর এ লোকের আমল নিস্ফল করে দিলাম।’ (মুসলিম : ২৬২১)।
বান্দা আল্লাহর থেকে যত দূরে চলে যাক, যতক্ষণ সুযোগ থাকে, তাকে তওবা করে নিতে হবে। রাসুল (সা.)-এর কাছে এক অশিতীপর বৃদ্ধ এসে বলল, ‘কেউ যদি সব ধরনের পাপ কাজ করে ফেলে, পাপের কোনোটাই বাদ না দেয়; এরপরও কি তার তওবার সুযোগ আছে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি কি ইসলাম গ্রহণ করেছ?’ সে বলল, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। তিনি একক। তাঁর কোনো শরিক নেই। আপনি আল্লাহর রাসুল।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি ভালো কাজ করবে, মন্দ কাজ ত্যাগ করবে; আল্লাহ তোমার জন্য সবকিছু কল্যাণময় করবেন।’ সে বলল, ‘আমার বিশ্বাসঘাতকতা ও গুরুতর মিথ্যাকথাগুলোও ক্ষমা করবেন?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সে আল্লাহু আকবার বলতে বলতে রাসুল (সা.)-এর সামনে থেকে আড়ালে চলে গেল। (তাবারানি কাবির : ৭২৩৫)।
যে কথা সবাইকে জানতে হবে : মানুষকে একটি সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। ভালোর প্রতি মানুষের সহজাত টান রয়েছে। মানুষ ভালোকে গ্রহণ করে, মন্দের ওপর তাকে প্রাধান্য দেয়। অনিষ্ট অপছন্দ করে, অনিষ্টকে প্রতিহত করতে চায়। অতএব, প্রত্যেক গোনাহগারকে নিজের ভালো গুণগুলোর পরিচর্যা করতে হবে। সেটিকে শক্তিশালী করতে হবে, বাড়িয়ে তুলতে হবে। ভালো গুণগুলো যখন শক্তিশালী হবে, মন্দ শক্তি তখন নিষ্প্রভ হয়ে পড়বে। গোনাহের পথগুলো সংকীর্ণ হয়ে উঠবে। শয়তানের ছিদ্রপথ বন্ধ হয়ে যাবে। কেউ যেন নিজের গোনাহকে তওবার জন্য প্রতিবন্ধক না বানায়। সবাইকে ভালো করে জানতে হবে, গোনাহগারের জন্য কখনও আল্লাহর রহমতের দরজা বন্ধ হয় না। গোনাহ যত বড়ই হোক, তার থেকে ফিরে আসার চেষ্টা অব্যাহত থাকা চাই। এক ব্যক্তি একশ’ লোক হত্যা করেছিল। এত বড় গোনাহ সত্ত্বেও সে নিরাশ হয়নি। তওবার জন্য নিজের এলাকা থেকে বেরিয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির সন্ধানে রওনা করেছে। পথিমধ্যে তার ইন্তেকাল হয়ে গেছে। সেও আল্লাহর দয়াপ্রাপ্ত হয়েছে। রহমতের ফেরেশতারাই তার আত্মা গ্রহণ করেছেন।
মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুইনুল ইসলাম