ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন ইসলামের দৃষ্টিকোণ

থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন ইসলামের দৃষ্টিকোণ

প্রাচীন পারস্যের পরাক্রমশালী সম্রাট জামশিদ খিষ্টপূর্ব ৮০০ সালে নববর্ষ প্রবর্তন করেন। পরে ব্যাবিলনের সম্রাট জুলিয়াস সিজার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ সালে ইংরেজি নববর্ষ প্রচলন করেন। প্রথম দিকে নববর্ষ বিভিন্ন তারিখে পালন করা হতো। পরবর্তী সময়ে ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর ১ জানুয়ারিকে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। বাংলাদেশে থার্টিফার্স্ট নাইটের ব্যাপক প্রচলন ঘটে ২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতের মিলেনিয়াম বা সহস্রাব্দ পালনের মধ্য দিয়ে। এ রাতের ১২টা ১ মিনিটকে ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ মুহূর্ত হিসেবে অভিহিত করা হয়।

থার্টিফার্স্ট নাইট মুসলিম সভ্যতা নয় : বছরের শেষ রাতের এ মুহূর্তটি উদযাপন একটি খ্রিষ্টীয় সংস্কৃতি। বিশ্বব্যাপী ইসলামি স্কলাররা ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ উদযাপনকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন। মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে এটি একটি অপসংস্কৃতি। তাই একজন রুচিশীল ও সচেতন ঈমানদার মুসলমান কখনও থার্টিফার্স্ট নাইট সংস্কৃতি উদযাপন করতে পারে না। বিজাতীয় সংস্কৃতি উদযাপনে কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা এমনই। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের অনুসরণ করবে, কখনও তার সেই আমল গ্রহণ করা হবে না। আর পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ৮৫)।

মুসলমান বিজাতীয় সংস্কৃতির সহযোগী নয় : থার্টিফার্স্ট নাইটে মুখে উচ্চারণ করে কিংবা ম্যাসেজের মাধ্যমে অভিবাদন জানানো, আতশবাজি, পটকাবাজি, ফ্যাশন শো, ট্যাটু বা উল্কা অঙ্কন, ডিজে পার্টি ও কনসার্ট, নেশা সেবনসহ বিজাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সাদৃশ্য রাখাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। বিজাতীয় সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণই নয়, বরং মুসলিমদের কোনো কাজে মুশরিকদের সাহায্যও গ্রহণ করতেন না নবীজি (সা.)। কারণ প্রত্যেক জাতির জন্যই রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধান ও করণীয়। সে আলোকে মুসলিমদের জন্য রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক জাতির জন্য আমি একটি নির্দিষ্ট বিধান এবং সুস্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।’ (সুরা মায়েদা : ৪৮)। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করল, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৩৪৭)।

শিরকযুক্ত সেøাগান : মুসলিমদের অনেকেই বর্ষবরণ করতে গিয়ে শিরকে লিপ্ত হয়ে ঈমানহারা হচ্ছে। এ রাতে তাদের সেøাগান হচ্ছে, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা।’ এ সেøাগানে অগ্নিপূজকদের আগুন দ্বারা পবিত্র হওয়ার ভ্রান্ত বিশ্বাস সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে। অথচ আগুনকে সম্মান করা, আগুনের কাছে সাহায্য চাওয়া এবং আগুন দ্বারা পবিত্র হওয়ার ধারণা করা শিরক। অথচ আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শিরককারীকে ক্ষমা করবেন না।’ (সুরা নিসা : ১১৬)।

অনর্থক সময়ের অপচয় : পশ্চিমা সংস্কৃতি নামের অপসংস্কৃতি হচ্ছে কথিত থার্টিফার্স্ট নাইট, যা মুসলিম সমাজে অসার, অনর্থক ও শয়তানি কাজ হিসেবেই স্বীকৃত। আল্লাহতায়ালা এ ধরনের বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকতে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই বিশ্বাসীরা সফলকাম হয়েছে, যারা নামাজে বিনয়ী-নম্র, যারা অসার ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকে।’ (সুরা মোমিনুন : ১-৩)। অন্য আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। যে কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তখন তো শয়তান নির্লজ্জতা ও মন্দ কাজেরই আদেশ করবে।’ (সুরা নুর : ২১)।

অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা : অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা ইসলামে গর্হিত ও নিকৃষ্টতম পাপাচার বলে গণ্য। থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনের নামে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, সমুদ্রসৈকত ও নাইট ক্লাবে যুবক-যুবতীরা অবাধে মেলামেশা ও অপকর্মে লিপ্ত হয়, যা ইসলামের পরিভাষায় জিনা বা ব্যভিচার হিসেবে আখ্যায়িত। অথচ আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩২)। অন্য আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, ‘মহান আল্লাহ যাবতীয় অশ্লীল ও অন্যায় কাজ হারাম করেছেন।’ (সুরা আরাফ : ৩২)। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যেসব নারী পোশাক পরিহিতা, কিন্তু নগ্ন; যারা পরপুরুষকে আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও আকৃষ্ট হয়; তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধবিশিষ্ট উটের মতো; তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না।’ (মুসলিম : ২১২৮)।

গানবাজনা : অশ্লীল গানবাজনা ইসলামে নিষিদ্ধ। এ রাতে বর্ষবরণের নামে আয়োজিত হয় বিভিন্ন ধরনের অশ্লীল কনসার্ট। যেখানে নারী-পুরুষের একসঙ্গে গানবাজনা, নগ্ননৃত্য আবশ্যকীয় বিষয়। অথচ আল্লাহতায়ালা ও রাসুল (সা.) এসব নিন্দনীয় কাজকে সম্পূর্ণ হারাম ও অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। যারা এসব কাজে লিপ্ত হয়, তাদের জন্য কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘একশ্রেণির লোক আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে, এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ (সুরা লোকমান : ৬)।

আতশবাজি ও পটকাবাজি : এ রাতে আনন্দ-উল্লাস করার জন্য মধ্যরাত থেকে শুরু হয় আতশবাজি ও পটকাবাজি, যা জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি করে। এর দ্বারা অগ্নিসংযোগেরও আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া এসব কর্মকা- জনসাধারণের জন্য কষ্টদায়ক ও বিরক্তিকর কারণ হয়। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘যারা বিনা অপরাধে মোমিন নর-নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহজাব : ৫৮)।

অর্থ অপচয় : এ রাতকে কেন্দ্র করে অনেক অর্থ অনৈসলামি ও হারাম কাজে ব্যয় করা হয়, যা একদিকে যেমন মারাত্মক গোনাহের কাজ, অন্যদিকে অপচয়। আর ইসলাম অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের বড়ই অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৭)।

থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনকারীর ব্যাপারে ধমক : যারা ইসলামের আওতায় নেই, নিঃসন্দেহে তারা কাফের-মুশরিকদের অন্তর্গত। তাই কাফের-মুশরিকদের অনুসরণও ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই সব প্রাণির মাঝে আল্লাহর কাছে কাফেররাই নিকৃষ্ট; যারা ইমান আনেনি।’ (সুরা আনফাল : ৫৫)। তাই আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন, ‘হে মুসলিমরা! তোমরা ওই জালেমদের দিকে একটুও ঝুঁকবে না। অন্যথায় জাহান্নামের আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে।’ (সুরা হুদ : ১১৩)।

প্রকৃত মুসলমানের করণীয় : মুসলমানের উৎসব ইবাদতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ বিষয়টি অনুধাবন করতে হলে ইসলামের সার্বিকতাকে বুঝতে হবে। ইসলাম কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়, বরং তা মানুষের গোটা জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী বিন্যস্ত ও সজ্জিত করতে উদ্যোগী হয়। তাই একজন মুসলিমের জন্য জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইবাদত। যেমনটি আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত : ৫৬)। সুতরাং মোমিন হিসেবে আমাদের কর্তব্য, থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনসহ এ ধরনের সব বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকা। কথিত বর্ষবরণ বা উৎসবের নামে সব ধরনের অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, হৈ-হুল্লোড় এবং নগ্নতা প্রদর্শনকে এড়িয়ে চলা। কারণ আল্লাহ মানুষকে জীবন-যৌবনের পূজা করার জন্য সৃষ্টি করেননি, বরং প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর একচ্ছত্র আনুগত্য করার জন্যই দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। আর মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীবের মর্যাদাও প্রদান করা হয়েছে। মূলত আমল বা কর্মের মাধ্যমেই মানুষকে তার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। মানুষকে সৎকাজের আদেশ, অসৎ এবং বেহুদাপনা থেকে বিরত রাখতে হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত; মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য তোমাদেরকে পাঠানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১১০)।

কোটেশেন

থাটি ফার্স্ট নাইটে মুখে উচ্চারণ করে কিংবা ম্যাসেজের মাধ্যমে অভিবাদন জানানো, আতশবাজি, পটকাবাজি, ফ্যাশন শো, ট্যাটু বা উল্কা অঙ্কন, ডিজে পার্টি ও কনসার্ট, নেশা সেবনসহ বিজাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সাদৃশ্য রাখাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। বিজাতীয় সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণই নয়, বরং মুসলিমদের কোনো কাজে মুশরিকদের সাহায্যও গ্রহণ করতেন না নবীজি (সা.)। কারণ প্রত্যেক জাতির জন্যই রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধান ও করণীয়। সে আলোকে মুসলিমদের জন্য রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত