ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

একটি মৃত্যু দেখার গল্প

একটি মৃত্যু দেখার গল্প

২০১০ সালের ১৯ জুলাই। সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম নানুকে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ২-৩ মাস পুরোপুরি শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। পাকস্থলির পুরোটা তখন তার ক্যান্সারের দখলে। মারা যাওয়ার দুই মাস আগ থেকে পানি আর ফলের রস ছাড়া কিছুই খেতে পারতেন না তিনি। শেষের দিকে তাও মুখে নিতে পারতেন না। গলা বেয়ে খাবার নামার পরপরই আরম্ভ হতো অসহ্য যন্ত্রণা। নানুর আর্তনাদের কিছু কথা এখনও আমার কানে বাজে। পেটের দিকে ইশারা করে ক্ষীণ গলায় বলতেন, ‘আগুন, পাথর।’

জীবনে প্রথমবার এবং ওইবারই আমি মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখেছি। নানাভাই নানুর মাথার পাশে বসে অনবরত সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করছিলেন। আর নানুকেও তেলাওয়াত করতে বলছিলেন। নানু অর্ধেক সুরা মুখে আওড়াতে পেরেছিলেন, তারপর সব আয়াত মনে করতে পারছিলেন না। নানু ছিলেন পতিপরায়ণা নারী। তার শেষ ইচ্ছেটা এখনও আমার বুক কাঁপায়। চলে যাওয়ার আগে নানাভাইকে ক্ষীণ গলায় কী যেন বললেন। পরে জানতে পারলাম, তাকে কবর দেওয়ার আগে যেন নানাভাইয়ের মাথার পাগড়িটা তার মাথায় পরিয়ে দেওয়া হয়, সেই আবদার করেছিলেন। ভাবা যায়? একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে মারা যাওয়ার সময়ও তার এই কথা মনে পড়ে!

নানু জীবনের শেষ পানিটুকুও পান করেছিলেন নানাভাইয়ের হাতে। আর কারও হাতের পানি নানু মুখে নিচ্ছিলেন না। সবাই নানুর ইচ্ছেটা তখন বুঝতে পারল। আমি সারাজীবনের জন্য ওইদিন হারিয়ে ফেললাম আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটাকে। নানু অসুস্থ অবস্থায় নিজের কত রাকাত সালাত কাজা হলো, সব হিসেব করে রাখতেন। সুস্থ হয়ে আদায় করে নেবেন, এই আশায়। মাঝেমধ্যে আফসোস হয়, দিনের পর দিন মরণ যন্ত্রণায় শয্যাশায়ী মানুষটা তার আমল নিয়ে কতটা সচেতন ছিলেন! আর আমরা হেলায়-খেলায় কত সালাত মিস করি, তার ইয়ত্তা নেই। ১৫ বছর আগের দৃশ্যগুলো এখনও আমার চোখে ভাসে। শীতের সকালে উঠোনের রোদে বসে আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে নানু আমায় সুরা ফাতিহা, ইখলাস, কাউসার শিখিয়েছিলেন। নানুর কিছু ধর্মীয় বইপত্র আমার কাছে রেখেছি। তার তসবিটাও সবসময় আমার ব্যাগে রাখি। এগুলোর মধ্যেই আমি তার গন্ধ খুঁজে পাই। আমার জীবনে দেখা একমাত্র মানুষ আমার নানু; যাকে আমি কোনোদিনও কারও সঙ্গে রেগে কথা বলতে দেখিনি। অমায়িক একজন মানুষ ছিলেন তিনি। নারীদের কোরআন পড়া শেখানোর কাজে আর ব্যক্তিগত আমল করতে করতেই খুব সাধারণভাবে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন।

কোটেশন

মাঝেমধ্যে আফসোস হয়, দিনের পর দিন মরণ যন্ত্রণায় শয্যাশায়ী মানুষটা তার আমল নিয়ে কতটা সচেতন ছিলেন! আর আমরা হেলায়-খেলায় কত সালাত মিস করি, তার ইয়ত্তা নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত