ঢাকা মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মহাবিশ্বের প্রথম চোখ হাবল

মহাবিশ্বের প্রথম চোখ হাবল

এই সেদিন মহাকাশে গিয়ে কাজ শুরু করল জেমস ওয়েব। এর আগে ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ মহাকাশ দূরবীন ছিল হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। কিছুদিন আগেই ৩৫ বছরে পা দিয়েছে এটি। হাবল এমন এক টেলিস্কোপ, যা মানুষের মহাবিশ্বকে দেখার চোখটাই বদলে দিয়েছে। গত ৩৫ বছরে হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীবাসীকে উপহার দিয়েছে মহাকাশের প্রায় ১৬০ কোটি ছবি, যা গবেষক তো বটেই, সাধারণ মানুষকেও সুযোগ দিয়েছে সহাকাশ সম্পর্কে জানার। বিগ ব্যাং, যা থেকে এই মহাবিশ্বের শুরু, সেটি যে প্রায় এক হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে ঘটেছিল, সে ধারণাও দিয়েছে হাবল। ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল টেলিস্কোপটিকে মহাকাশে পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ২০২৫ সালে এসে নিজের মহাকাশ যাত্রার ৩৫ বছর পূর্ণ করল টেলিস্কোপটি। এ বিশেষ মুহূর্তে হাবলের কিছু নতুন ছবি প্রকাশ করেছে নাসা, যেখানে সৌরজগত থেকে শুরু করে অনেক দূরের মহাকাশের নানা দৃশ্যের ঝলক মিলেছে। যেমন- মঙ্গলের রুক্ষ লাল মাটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন তারা যেখানে জন্ম নেয় এমন কুয়াশার মতো নীহারিকা ও কাছের এক ছায়াপথের ছবি। এসব নতুন ছবি কেবল হাবলের জন্মদিনের উপহারই নয়, বরং এটি আমাদের মনে করিয়ে দিল, হাবল টেলিস্কোপ আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মানুষের মহাকাশ নিয়ে ভাবনার ধরন কতটা বদলে দিয়েছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট আর্থডটকম।

হাবলের ঝাপসা শুরুর সমাধান: ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল মহাকাশে উড়াল দেয় স্পেস শাটল ‘ডিসকভারি’। আর তার ভেতরে ছিল ভাঁজ করে রাখা হাবল টেলিস্কোপ। নাসার এক ভাষ্যকার তখন হাবল সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘মহাবিশ্বের দিকে নতুন এক জানালা’, যা মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে আকাশচুম্বী করে তুলেছে। টেলিস্কোপটি মহাকাশে পাঠানোর পর সবাই খুব আশাবাদী হলেও কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন এর প্রধান ক্যামেরায় তোলা ছবি ঝাপসা আসছে। এরপরই তাদের উল্লাস দ্রুত ম্লান হয়ে যায়। পরবর্তীতে জানা যায়, হাবলের প্রধান আয়নাটিতে কেবল ২ মাইক্রোন অর্থাৎ চুলের থেকেও ছোট আকারের একটি ভুল ছিল। ওইসময় এই ছোট্ট ভুলই বিশাল প্রভাব ফেলেছিল হাবলে। তবে বিজ্ঞানীরা হাল ছেড়ে দেননি। ১৯৯৩ সালে উদ্ধার অভিযানে নভোচারীরা এক বিশেষ যন্ত্র বসান হাবলে, যা এর ভুল আয়নার জন্য একটা ‘চশমার’ মতো কাজ করে এবং এটি হাবলের ক্যামেরা ও ইলেকট্রনিক্সকে আপগ্রেডও করেছে। এই সারানোর কাজ শেষ হবার পর সঠিকভাবে কাজ করতে শুরু করে হাবল। আর এ কাজটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে সফল মহাকাশ মেরামতের মধ্যে একটি। নাসার সদর দপ্তরের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক শন ডোমাগাল-গোল্ডম্যান বলেছেন, ‘৩৫ বছর আগে মহাকাশে যাত্রার সময় মহাবিশ্বের জন্য এক নতুন জানালা খুলে দিয়েছিল হাবল।’

সেই সন্ধিক্ষণের পর থেকে প্রায় ১৭ লাখ পর্যবেক্ষণ করেছে হাবল টেলিস্কোপ এবং ৫৫ হাজারটি মহাজাগতিক বস্তু ও তারায় মনোযোগ দিয়েছে এটি। হাবলের এসব তথ্য দিয়ে ২২ হাজারের বেশি গবেষণাপত্র লিখেছেন গবেষকরা এবং ১৩ লাখেরও বেশি বার উদ্ধৃত হয়েছে এগুলো। আর এ কারণেই এখন পর্যন্ত ‘সবচেয়ে সফল’ টেলিস্কোপ হিসেবে পরিচিত হাবল। হাবলের সব অসম্পাদিত ছবি ও বর্ণালীর ডিজিটাল সংগ্রহের আকার মোট চারশ’ টেরাবাইটেরও বেশি। এটি পাবলিক আর্কাইভ হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে, যা প্রতি বছর নতুন নতুন আবিষ্কারের ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে।

এ মিশন দীর্ঘ সময় ধরে চলার কারণে মহাকাশের দৃশ্যগুলো আবারও দেখে এদের বদলানোর প্রক্রিয়া প্রায় বাস্তব সময়ে অনুসরণ করতে পেরেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। মঙ্গল ও শনি গ্রহের মৌসুমি পরিবর্তন ট্র্যাক করেছে হাবল। পাশাপাশি সুপারনোভা বিস্ফোরণের অবশিষ্ট অংশ ছড়িয়ে যেতে দেখেছে, সক্রিয় ছায়াপথের কেন্দ্রের উজ্জ্বল অংশ পর্যবেক্ষণ করেছে ও গ্রহাণু সংঘর্ষের পরবর্তী আভাও ধারণ করেছে এটি। যেভাবে মহাবিশ্বকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করল হাবল: হাবলের আগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কারণে মাটিতে থাকা বিভিন্ন টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের শুধু অর্ধেক অংশই দেখতে পেত। ওই সময় মহাবিশ্বের বয়স নিয়ে অনুমান ছিল খুব এলোমেলো এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কেবল আন্দাজ করতে পারতেন, প্রত্যেকটি ছায়াপথের কেন্দ্রেও কি একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল আছে কি না। অন্য তারার আশপাশে গ্রহের অস্তিত্বের বিষয়টি তখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেসব আখ্যান নতুন করে লিখেছে হাবল। এর তোলা জনপ্রিয় বিভিন্ন ‘ডিপ ফিল্ড’ ছবিতে দেখা মিলেছে, বহু পুরোনো ও ক্ষীণ ছায়াপথের এক বিশাল সমষ্টি, যা এক হাজার তিনশ’ কোটি বছরেরও বেশি পুরোনো। পরিবর্তনশীল তারা ‘সেপহেইড’ ও আইএ টাইপের সুপারনোভা ট্র্যাক করে হাবল টেলিস্কোপ মহাবিশ্ব সম্প্রপ্রসারণের গতি নির্ধারণ করে। এটি ডার্ক এনার্জি উন্মোচনেও সহায়তা করেছিল। এ আবিষ্কারটি পরে ২০১১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জিতেছে। প্রথমবারের মতো এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডল মাপতে সাহায্য করেছিল হাবল এবং এটি প্রমাণ করেছে, বেশিরভাগ বড় ছায়াপথের কেন্দ্রে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল রয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত