প্রোটিনের বিকল্প উৎস হতে পারে কালো সৈনিক পোকা (ব্ল্যাক সোলজার্স)। যার লার্ভা প্রোটিনের একটি ভালো উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। পোকাটি মাছ, হাঁস-মুরগির বিকল্প খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। শুকনো অবস্থায় এই পোকার লার্ভা থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত উচ্চ প্রোটিন পাওয়া সম্ভব। যা প্রাণিজ প্রোটিনের একটি বড় উৎস।নওগাঁয় প্রথমবারের মতো কালো সৈনিক পোকা চাষ করে সাড়া ফেলেছেন আহসান হাবিব। তিনি পেশায় একজন কৃষক এবং সদর উপজেলার তিলোকপুর ইউনিয়নের উলিপুর গ্রামের বাসিন্দা। বেসরকারি সংস্থা পিকেএসএফ এর কারিগরি সহযোগিতায় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা মৌসুমী বাস্তবায়ন করছে। আহসান হাবিব প্রোটিন সমৃদ্ধ এই পোকাটি চাষ করে পুকুরে মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। পাশাপাশি উদ্বৃত্ত পোকা বিক্রি করে মাসে অর্ধলাখ টাকা আয় করছেন তিনি। এমন উদ্যোগের মাধ্যমে এলাকায় বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে এবং ছোটো ও মাঝারি আকারে খামার গড়ে উঠছে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই পোকা চাষ দ্রুত জেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।
কালো সৈনিক পোকা বাসাবাড়ি, পচনশীল ফলমূল, শাকসবজি ও বাজারের ময়লা আবর্জনা পুনঃব্যবহার করে উৎপাদন করা যায়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও কম্পোস্টিং করতেও এই পোকার লার্ভা যেকোনো জৈব বর্জ্য ভক্ষক হিসেবে কাজ করতে পারে। এতে মাছ চাষে খাবারের বিকল্প হিসেবে এই পোকা ব্যবহারে খরচ কমছে অনেকাংশ। ফলে বিষমুক্ত মাছ চাষে লাভবান হচ্ছেন মৎস্য চাষিরা। কালো সৈনিক পোকা গুলো একটি জালের মধ্যে দিনের আলো-বাতাস আসে এমন জায়গায় রাখতে হয়। পোকাগুলো প্রজনন সম্পন্ন করার পর সেখানে কাঠের স্তরের মধ্যে ডিম পাড়ে। সেই ডিমগুলো হ্যাচিং করে ফোটানোর কিছুদিন পর আলাদা করে অন্য জায়গায় রাখা হয়। এরপর সেখান থেকে তৈরি হয় লার্ভা। কৃষক আহসান হাবিব বলেন- কৃষি কাজের পাশাপাশি পুকুরে মাছ চাষ করেন। মাছের খাদ্য হিসেবে ফিড খাওয়াতে হতো। বাজারে ফিডের দাম বাড়লেও তুলনামুলক ভাবে মাছের দাম পাওয়া যেতো না। এতে মাছ চাষে কিছুটা লোকসানে পড়তে হয়েছিল। পরবর্তীতে ইউটিউবে ভিডিও দেখে ২০১৯ সালে মাছের খাবারের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব কালো সৈনিক পোকা উৎপাদনে আগ্রহী হয়। এরপর স্বল্প পরিসরে খামার তৈরী করা হয়। প্রথম দিকে খামার হতে মাসে এক থেকে দেড় মণ লার্ভা উৎপাদন হতো। পরবর্তিতে ২০২৪ সালে বেসরকারি সংস্থা মৌসুমী হতে খামার সম্প্রসারণে আর্থিক সহায়তা নিয়ে বড় আকারে খামার করা হয়। বর্তমানে প্রতি মাসে খামার থেকে প্রায় ৪ মন লার্ভা উৎপাদন হচ্ছে।
তিনি বলেন- মাছ চাষের প্রয়োজন মিটিয়ে প্রতি মাসে পোকা বিক্রি করে প্রায় ৫০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। মাছের খাদ্যে প্রোটিন হিসেবে ব্যবহার করে মাছ চাষে প্রায় ৫০ শতাংশ খরচ সাশ্রয় করা সম্ভব। এই পোকা উৎপাদনে আলাদা কোন খাবারের প্রয়োজন হয় না। বাড়ি, হোটেল ও বাজারের উচ্ছিষ্ট এবং আবর্জনা পোকার খাবার। তাই একদিকে ময়লা, আবর্জনা এবং উচ্ছিষ্ট পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ যেমন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। তবে উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আগামীতে এই পোকার শুকনো পাউডার তৈরি করে ফিডের মতো ব্যবহার করা সম্ভব।
একই গ্রামের আরেক মাছ চাষি রাজা বলেন- এ বছর ৫ বিঘার একটি পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেছি। মাছের খাবারের দাম অনেক বেশি হওয়ায় খরচ অনেক বেশি পড়ছে। তবে আহসান হাবীব কালো সৈনিক পোকা চাষ করে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছেন। নিজের চাহিদা পূরণের পর বাইরে বিক্রি করেও তিনি আর্থিক ভাবে লাভ হচ্ছেন। তাই মাছের বিকল্প খাবার হিসেবে তার কাছ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে কালো সৈনিক পোকা চাষ শুরু করার পরিকল্পনা করছি।
মৌসুমী আরএমটিপি প্রকল্পের মনিটরিং কর্মকর্তা আব্দুর রউফ পাভেল বলেন- জেলায় আগ্রহী মাছ চাষীদের মাধ্যমে কালো সৈনিক পোকা চাষের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এটি ব্যাপক সম্ভবনাময়। চাষীদের অধিক লাভবান করা সহ ভোক্তাদের মাঝে স্বাস্থ্যসম্মতমাছ পৌঁছে দিতেই এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামীতে এই প্রকল্পটি আরো বিভিন্ন উপজেলায় ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
নওগাঁ সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো: বায়েজিদ আলম বলেন- পরিবেশ বান্ধব এই কালো সৈনিক পোকার অনেক উপকারী দিক রয়েছে। এই পোকার খাবার উচ্ছিষ্ট, ময়লা ও আবর্জনা। ফেলে দেয়া ডাস্টগুলো রিসাইকেল হতে যে ক্ষতিকর গ্রীণ হাউজ গ্যাস নিঃসরণ ঘটে তা শোষণ করে। মাছ চাষী ও ভোক্তাদের মাঝে এই পোকার উপকারী দিক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষ করে ভোক্তাদের এই পরিবেশবান্ধব পোকার মাধ্যমে বড় হওয়া মাছ নিয়ে পজেটিভ ধারণা গড়ে তুলতে হবে। বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সরকারী ভাবেও আগ্রহীদের এই পোকা চাষের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।