
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনার দুই দিন পর গতকাল বুধবার থেকে ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তবে, ক্যাম্পাসে নেই পুরনো সেই শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি। আড্ডা মুখোর ক্যাম্পাসের ঝুপড়িগুলো পড়ে আছে শিক্ষার্থী শূন্য। হাতেগোনা কয়েকটি বিভাগে ক্লাস পরীক্ষা সচল থাকলেও কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ সহ অন্যান্য অনুষদের অধিকাংশ বিভাগের ক্লাসগুলো পড়ে আছে ফাঁকা।
গত শনিবার দিবাগত রাত থেকে স্থানীয় দুর্বৃত্তদের দ্বারা ক্রমাগত হামলার শিকার হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রায় ১ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী হতাহত হয়েছে বলে জানা গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির মেডিকেল সেন্টারের সিনিয়র মেডিকেল অফিসারের কাছ থেকে। আহতদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে অন্তত শতাধিক শিক্ষার্থী এবং আরও ৩ শিক্ষার্থী রয়েছে মরণাপন্ন পরিস্থিতিতে। মূলত রাতে বিশ্ববিদ্যালয়টির এক নারী শিক্ষার্থী তার ভাড়া ফ্ল্যাট বাসায় প্রবেশ করতে গেলে তাকে মারধর করে বাসাটির দারোয়ান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয়দের হামলার সূত্রপাত। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জানা গেছে, তারা এখনো ভীত সন্ত্রস্ত এবং উক্ত ঘটনার ভয়াবহ ট্রমা তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টির যেসকল অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা ২নং গেট সহ জোবড়া গ্রামে এতদিন বসবাস করে আসছিল তারা আবাসন সংকটের পাশাপাশি ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা সব থেকে বেশি আতঙ্কগ্রস্থ। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক নারী শিক্ষার্থী জানিয়েছে তাদেরকে নানান মাধ্যমে ধর্ষণ সহ বিভিন্ন হুমকি প্রদান করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্রী সুমাইয়া সিকদার জানান, এই বিষয়ের নিষ্পত্তি চাই। এগুলো আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যারা ২ নং গেট এলাকায় ছিল তারা ঐ এলাকায় ঢুকতেই পারতেছে না। বাসার নিচে এসে মুখে কাপড় বেঁধে হুমকি দিয়ে চলে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই বিষয় টা তো কন্টিনিউ চলতে পারেনা। আমাদের তো নিরাপত্তার একটা বিষয় আছে। আর এটাতো একটা ছেলে খেলা না যে গ্যাং রেপ করে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে, প্রশাসনের তো এই বিষয়গুলো দেখতে হবে।
শিক্ষার্থীদের স্বল্প উপস্থিতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল আমীন জানান, আমাদের শিক্ষার্থীরা কিছুটা ট্রমায় আছে, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। এত বড় একটি ঘটনা ঘটার পরে আমরা সকিং পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ইনশাল্লাহ আশা করি রবিবার থেকে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের সিরিয়াস উপস্থিতি বাড়বে।
সংঘর্ষের ঘটনার পর পরীক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন গণমাধ্যমে জানান, ৯টি বিভাগে পরীক্ষা চলছে। তবে আমরা বিভাগগুলোতে স্বাধীনতা দিয়েছে, তারা শিক্ষার্থীদের মানসিকতার ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষা নিতেও পারেন, আবার বন্ধও রাখতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান গণমাধ্যমে জানান, এখন থেকে ক্লাস নিয়মিত চলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী আহতরাও পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে।
সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার আট: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ঘটনায় আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামে অভিযান চালিয়ে মঙ্গলবার তাদের গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) কাজী মো. তারেক আজিজ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন, ইমরান হোসেন ওরফে এমরান (৩৫), মো. হাসান (২২), মো. রাসেল ওরফে কালা রাসেল (২৫), মো. আলমগীর (৩৫), নজরুল ইসলাম (৩০), মো. জাহেদ (৩০), মো. আরমান (২৪) ও দিদারুল আলম (৪৬)।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারেক আজিজ বলেন, ‘গ্রেপ্তারদের মধ্যে তিনজনের নাম মামলার এজাহারে রয়েছে। অপর পাঁচজন তদন্তে পাওয়া আসামি।’ মামলার এজাহারে ইমরান ৬১ নম্বর, হাসান ৬৪ নম্বর এবং রাসেল ৮৬ নম্বর আসামি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেইট সংলগ্ন একটি ভবনের ভাড়াটিয়া এক ছাত্রীর সঙ্গে ভবনের নিরাপত্তারক্ষীর বিতণ্ডার জেরে শনিবার মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। রাতে শুরু হওয়া ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া আর সংঘর্ষ পরদিন রোববারও চলে দফায় দফায়। তাতে শিক্ষার্থী, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য, উপউপাচার্যসহ কয়েকশ আহত হন। সংঘাতের মধ্যে রোববার দুপুর ২টা থেকে সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত ক্যাম্পাস ও আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
সংঘর্ষে উস্কানিদাতা বিরুদ্ধে মামলা করেনি চবি প্রশাসন: চবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনায় ৯৫ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ১ হাজার জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে এ সংঘর্ষে সরাসরি উস্কানিদাতা, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা উদয় কুসুম বড়ুয়ার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
জানা গেছে, সংঘর্ষের দিন (৩১ আগস্ট) উদয় কুসুম বড়ুয়ার উস্কানিমূলক ভিডিও বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে। একইদিনে তাকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিসহ দলের নির্দেশনা অমান্য করে সংগঠন বিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকায় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য উদয় কুসুম বড়ুয়াকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, উদয় কুসুম শিক্ষার্থীদের উপর হামলার জন্য স্থানীয়দের উস্কে দিয়েছিল। সেই ভিডিও বক্তব্য ছড়িয়ে পড়লে বিএনপি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু চবি প্রশাসনের দায়ের করা মামলার এজাহারে তার নাম নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী সৃজন বড়ুয়া বলেন, “মামলার এজাহারে উদয় কুসুম বড়ুয়ার নাম নেই কেন? অথচ এই লোকটিই গ্রামবাসীদের ছাত্রদের ওপর হামলার জন্য উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছে। যার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন এই ব্যক্তির নামে মামলা করল না?” ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলাম বলেন, “সে স্থানীয় হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসীদের বর্বরোচিত হামলার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং হামলা উস্কে দিয়েছে। একটি দলের কেন্দ্রীয় নেতা হয়েও তার এমন উস্কানিমূলক বক্তব্য কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। তার এ বক্তব্য শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় সরাসরি প্রভাব রেখেছিল। সারা দেশব্যাপী তাকে নিন্দা জানায়।” তিনি বলেন, “সংঘর্ষের দিনই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়ের করা মামলার এজাহারে তার নাম না থাকায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। অতিদ্রুত তার নামে মামলা দায়ের করে আইনের আওতায় আনা হোক।”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর যারা হামলা করেছে, তাদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরো ১ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। তিনি (উদয় কুসুম) অজ্ঞাতনামায় আসতে পারেন। তবে আলোচনার মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করাও হতে পারে।’