
আবহমান বাংলার ঐতিহ্য আর আতিথেয়তার প্রতীক ‘পান’। উৎসব, আড্ডা কিংবা গৃহস্থের দৈনন্দিন জীবনে এই পান একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। সেই পানের চাষকে ঘিরেই কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কয়েকটি গ্রাম, বিশেষ করে আলিকামোড়া, বাড়েরা ও মহিচাইল, বরুড়া সীমান্তবর্তী কাদুটি, পাইকের করতলা, চাঁদসার ও লনাই গ্রামে এখন যেন এক সবুজ বিপ্লব ঘটেছে। দিগন্তজোড়া পানের বরজগুলোতে লতার সবুজ পাতার প্রাচুর্যে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং রোগবালাই কম হওয়ায় পানের ফলন হয়েছে ‘বাম্পার’।
চান্দিনার এই চারটি গ্রামে প্রায় শত বছর ধরে পানের চাষ হয়ে আসছে। এরমধ্যে কাদুটি গ্রামকে পানের গ্রাম হিসেবেই চেনে অনেকে, যেখানে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ জড়িত পান চাষের সঙ্গে, ব্যবসা কিংবা শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখানকার মহালনী, চালতাগোটা ও সাচি জাতের পানের সুনাম রয়েছে সারা দেশে। সরেজমিন বরজগুলোতে গেলে দেখা যায় এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য বাঁশের টুকরোর ওপর খুব যত্নে বেড়ে উঠেছে পানের চারা। হালকা খড়ের ছাউনির ফাঁক দিয়ে সোনালী আলো এসে পড়ছে সবুজ পাতার লতানো ডগায়। ভোর থেকে শুরু হয়ে দিনভর চলে পান তোলা, বোঁটা ভাঙা ও ‘ভিড়া’ (৯৬টি পান একত্র করে আঁটি বাঁধা) তৈরির কাজ। পান তোলার সময় বোঁটা ভাঙার ‘টুসটুস’ শব্দে মুখর থাকে পুরো বরজ। এখানকার পান চাষ একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং লাভজনক প্রক্রিয়া। একবার বরজ তৈরি করলে ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে ফলন পাওয়া যায়। চাষিরা জানান, এক বিঘা জমিতে পান চাষ করতে খরচ হয়, আনুমানিক ৩ লাখ টাকা, আর ভালো ফলনে তা থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা সম্ভব হয়। পান চাষের কারণেই এই অঞ্চলের অনেক পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধি।
তবে চলতি মৌসুমে ফলন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলেও, বাজারে পানের দাম নিয়ে সন্তুষ্ট নন চাষিরা। কাদুটি গ্রামের পান চাষি কামাল হোসেনের কথায়, ‘ভালো ফলন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দাম পাচ্ছি না। আগে যে ‘ভিড়া’ পান ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা নেমে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় ঠেকেছে। বাঁশ, খড়, সার ও শ্রমিকের মজুরি, সবকিছুর দাম বাড়লেও পানের দাম কমে যাওয়ায় আমরা বেকায়দায় পড়েছি। আরেক কৃষক আবুল বাশার জানান, ফলন বেশি হওয়ায় বাজারে একযোগে পানের সরবরাহ বেড়েছে। আর এই অতিরিক্ত উৎপাদনের চাপেই দাম কমে গেছে। উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, চান্দিনা উপজেলায় ৪২ হেক্টর জমিতে পানের চাষ হয়, যারমধ্যে কাদুটি গ্রামেই রয়েছে ১২ হেক্টর। উপজেলা কৃষি অফিসার মুহাম্মদ মোরশেদ আলম স্বীকার করেন যে, অনুকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন বেশি হওয়ায় কৃষকরা বর্তমানে তুলনামূলক কম দাম পাচ্ছেন। তবে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, শীতের শুরুতে পানের চাহিদা বাড়লে দাম পুনরায় বৃদ্ধি পাবে এবং চাষিদের লোকসানের শঙ্কা কেটে যাবে। এদিকে, পান ব্যবসায়ীরাও জানান, চান্দিনার পানের স্বাদ ও মান চমৎকার হওয়ায় এর চাহিদা বিভিন্ন উপজেলায় রয়েছে। উৎপাদন বেশি হওয়ায় এখন তারা কম দামে কিনতে পারছেন। তবে চাষিরা বলছেন, সরকারিভাবে পান সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। তাদের দাবি, পানের বরজে রোগবালাই প্রতিরোধে কৃষি বিভাগের কারিগরি সহযোগিতা অব্যাহত থাকুক এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়া হোক। ফলনের প্রাচুর্য যেন শেষ পর্যন্ত কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, সেজন্য দামের স্থিতিশীলতা একান্ত কাম্য। আবার পান চাষীদের অনেকে বলে থাকেন, তাদের কে যদি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্বল্প সুদে কিম্বা বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেত তাহলে হয়তো পান চাষে তারা আরো সফলতা অর্জন করতে পারতেন। দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে তারাও একটা বিশাল ভূমিকা নিয়ে থাকেন। তাই তাদের এই শত বছরের পান চাষের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে এবং সামনের দিকে আরো গতিশীল করতে হলে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাহলে পান চাষের প্রতি আরও মানুষের আগ্রহ বাড়বে।