
গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়ার দশ ঘণ্টা পর দৈনিক ভোরের কাগজের অনলাইন প্রধান মিজানুর রহমান সোহেলকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। গতকাল বুধবার ভোরে তার স্ত্রীর জিম্মায় বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) শফিকুল আলম জানান। তিনি বলেন, ‘উনি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু অনুমতি ছাড়াই সভাপতি-সেক্রেটারির নাম ব্যবহার করেছিলেন। পরে আমরা ওই প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারিকে ডেকে আনি এবং বিষয়টি ভুল বুঝাবুঝি হওয়ায় ভোরবেলা সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে বাসায় দিয়ে আসা হয়।’ সোহেল নিজেও ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে ডিবি অফিস থেকে ছাড়া পাওয়ার কথা জানান। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, মোবাইল হ্যান্ডসেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজনেস কমিউনিটি বাংলাদেশের (এমবিসিবি) সংবাদ সম্মেলন প- করার জন্য ‘সরকারের একজন উপদেষ্টার ইশারায়’ তাকে আটক করা হয়েছিল, কারণ তিনি ওই সংগঠনের মিডিয়া পরামর্শক হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া একজনকে মধ্যরাতে গ্রেপ্তার কেন করা হল জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘এই জিনিসটা আমি আপনার কাছে প্রথম শুনলাম। ইনভেস্টিগেশন করার পরে বলতে পারব।’
‘ডিবি’ পুলিশ পরিচয় দিয়ে পাঁচ ব্যক্তি গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে নতুন বাড্ডার বাসা থেকে মিজানুর রহমান সোহেলকে তুলে নিয়ে যায়। তার স্ত্রী সুমাইয়া সীমার ভাষ্য, ‘ওই পাঁচজনের একজন নিজেকে আশরাফুল পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান সোহেলের সঙ্গে কথা বলতে চান। এজন্য তাকে নিতে এসেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়া হবে।’
সোহেল সেন্টার ফর টেকনোলজি জার্নালিজম (সিটিজে) নামে ঢাকার তথ্যপ্রযুক্তি সাংবাদিকদের একটি সংগঠনের সহ- সভাপতি। ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাইফ আহমাদ রাতে টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিটের সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো বার্তায় বলেন, ‘রাত ১২টার পর তাকে (সোহেল) বাসা থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনা শুধু উদ্বেগের নয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। ডিবিপ্রধান ঘটনাটি স্বীকার করলেও এত গভীর রাতে একজন সাংবাদিককে কেন এভাবে নেওয়া হল, তার স্বচ্ছ ব্যাখ্যা অত্যন্ত জরুরি।’
ছাড়া পাওয়ার পর বুধবার সকালে সোহেল এক ফেইসবুক পোস্টে বলেন, ‘বিনা অপরাধে’ প্রায় সাড়ে ১০ ঘণ্টা ডিবি হেফাজতে রাথার পর তাকে ‘সসম্মানে’ বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘গত রাত ১২টার দিকে ডিবি প্রধান আমার সঙ্গে কথা বলবেন, এই অজুহাতে ৫/৬ জন ডিবি সদস্য জোর করে আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। ডিবিতে নিয়ে আসামির খাতায় আমার নাম লেখা হয়। জুতাণ্ডবেল্ট খুলে রেখে গারদে আসামিদের সাথে আমাকে রাখা হয়। কিন্তু কেন আমাকে আটক করা হলো? তা আমি যেমন জানতাম না, তেমনি যারা আমাকে তুলে এনেছিলেন বা ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও কিছু বলতে পারেননি। দীর্ঘ সময় পর বুঝতে পারলাম, সরকারের একজন উপদেষ্টার ইশারায় মাত্র ৯ জন মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীকে মনোপলি ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়ার জন্যই আমাকে আটক করা হয়েছিল। আমার সাথে সংগঠনের (এমবিসিবি) সেক্রেটারি আবু সাঈদ পিয়াসকেও আটক করা হয়।’
ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্ট্রার (এনইআইআর) নিয়ে বুধবার ডিআরইউতে এমবিসিবির সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল জানিয়ে সোহেল লিখেছেন, ‘সেই প্রেস কনফারেন্স বন্ধ করাই তাদের প্রধান টার্গেট ছিল। কিন্তু তাদের জন্য আফসোস, যে উদ্দেশ্যে তারা প্রেস কনফারেন্স বন্ধ করতে চাইল, সেটা দেশের সবাই জেনে গেল।’ তার অভিযোগ, ‘দেশের মুক্ত বাণিজ্য নীতির সঙ্গে এনইআইআর স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক। প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে দেশে প্রতিযোগিতা কমিশনও রয়েছে। অথচ মাত্র ৯ জন ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে সারাদেশে ২৫ হাজার মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীকে পথে বসানোর গভীর চক্রান্ত চলছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গ্রামের সাধারণ মানুষ, প্রবাসীসহ অনেকেই বিপদে পড়বেন। একটা চেইন ভেঙ্গে পড়বে। অনেক ব্যবসায়ী পথে বসে যাবে। জেনে রাখা ভালো, এই ৯ জনের একজন ওই উপদেষ্টার স্কুল-বন্ধু।’ সোহেল লিখেছেন, ‘একটা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বললে সরকার কেন ভয় পায়? শুধুমাত্র প্রেস কনফারেন্স বন্ধ করতেই কি আমাকে গভীর রাতে জোর করে তুলে নিতে হল? যারা মুখে ‘বাকস্বাধীনতা’র বুলি আওড়ান, তারাই কি আমাকে বাকরুদ্ধ করতে এই আয়োজন করলেন? মগের মুল্লুকে এই কি তবে বাকস্বাধীনতার বাস্তব চিত্র?’
সাংবাদিক সোহেলকে আনার কারণ জানাল ডিএমপি : মিজানুর রহমান সোহেলকে তথ্য যাচাইয়ের জন্য ডিবিতে আনা হয় বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। গতকাল বুধবার ডিএমপির উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘দৈনিক ভোরের কাগজের অনলাইন এডিটর মিজানুর রহমান সোহেলকে আটক করা হয়নি। তথ্য যাচাইয়ের জন্য তাকে আনা হয়। তার ফোন নম্বরটি একটি সংবেদনশীল জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছিল। সে কারণেই তাকে আনা হয়েছিল। পরে স্ত্রীর জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিক মিজানুরকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই- ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব : ভোরের কাগজের অনলাইন এডিটর মিজানুর রহমান সোহেলকে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) জিজ্ঞাসাবাদে নিজের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রধান উপদেষ্টার ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে ‘অসত্য’ তথ্য প্রচার করা হচ্ছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।
গতকাল বুধবার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ জসীম উদ্দিনের মাধ্যমে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের বক্তব্য আসে। ফয়েজ আহমদ তৈয়বকে উদ্ধৃত করে মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো গণমাধ্যম আমার ওপর দায় চাপিয়েছে। তাদের উদ্দেশেই আমার বক্তব্য- এটা অনভিপ্রেত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কাজ করে। এখানে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকার অবকাশই নেই।’
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার স্বার্থেই আমরা এনইআইআর বাস্তবায়ন করছি। অবৈধ হ্যান্ডসেটের লাগাম টানতে সংক্ষুব্ধ পক্ষের সঙ্গে বিটিআরসি বৈঠকও করেছে।’ মিজানুরকে জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে এনইআইআর বাস্তবায়নের সঙ্গে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকে জড়িয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ‘মনের মাধুরী মিশিয়ে সত্যের অপলাপ’ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘এমন ‘প্রোপাগান্ডা’ মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতাকেই ভুলুণ্ঠিত করছে। আমরা মনে করি, এ ধরনের অসত্য তথ্য প্রচার জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাই আশা করি, এরপর আর কেউ এ ধরনের লেখায় বিভ্রান্ত হবেন না।’