
শীত এলেই গ্রামবাংলায় শুরু হয় খেজুরের রসের মৌসুম। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে গাছের মাথায় হাঁড়ি ঝুলছে, আর শহরে সেই রসের খোঁজে ছুট। কারও কাছে এটি শীতের বিলাস, কারও কাছে নস্টালজিয়া। তবে প্রশ্ন হলো এই খেজুরের রস কি কাঁচা অবস্থায় খাওয়া নিরাপদ? খেলেও কীভাবে, কতটুকু? এর উপকারিতা আর ঝুঁকিই বা কী?
খেজুরের রস কীভাবে আসে : খেজুর গাছের কাণ্ড কেটে বিশেষভাবে রস সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত রাতের বেলায় হাঁড়ি বসানো হয়, ভোরে সেই হাঁড়ি নামিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। এই রসই কাঁচা খেজুরের রস। মিষ্টি, হালকা ঘোলাটে আর খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে এতে।
কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া কি নিরাপদ : এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি আছে, যদি তা পরিষ্কার ও সুরক্ষিত উপায়ে সংগ্রহ না করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, খেজুরের রসের হাঁড়িতে বাদুড়, পাখি বা পোকামাকড় বসতে পারে। বাদুড়ের লালা বা মল থেকে নিপাহ ভাইরাসের মতো মারাত্মক জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। খোলা হাঁড়িতে রাখা রস দ্রুত ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। এই কারণে অপরিশোধিত, খোলা অবস্থায় সংগৃহীত কাঁচা রস সরাসরি পান করা ঝুঁকিপূর্ণ।
তাহলে কীভাবে খেলে নিরাপদ : খেজুরের রস খেতে চাইলে কিছু নিয়ম মানা জরুরি। হাঁড়ি যদি পরিষ্কার কাপড় বা বাঁশের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়, তাহলে জীবাণুর ঝুঁকি অনেকটাই কমে। রস সংগ্রহের পর অন্তত ৫-১০ মিনিট ফুটিয়ে নিলে ক্ষতিকর জীবাণু নষ্ট হয়। ফুটানো রস কিছুটা রঙ বদলালেও নিরাপদ। রস দীর্ঘক্ষণ রেখে দিলে ফারমেন্টেশন শুরু হয়। সংগ্রহের ৪-৬ ঘণ্টার মধ্যেই খেয়ে নেওয়া ভালো। পরিচিত ও পরিচ্ছন্ন গাছি (রস সংগ্রাহক) থেকে নেওয়া রস তুলনামূলক নিরাপদ।
কতটুকু খাওয়া উচিত : খেজুরের রস প্রাকৃতিক হলেও এতে চিনি অনেক বেশি। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দিনে এক কাপ (১৫০-২০০ মিলি) যথেষ্ট। শিশুদের জন্য অর্ধেক কাপের বেশি না। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কাঁচা রস না খাওয়াই ভালো বা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নয়। অতিরিক্ত খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, পেটের সমস্যা বা ডায়রিয়া হতে পারে।
খেজুরের রসের উপকারিতা : সঠিকভাবে খেলে খেজুরের রসের কিছু গুণ রয়েছে। যেমন- প্রাকৃতিক শক্তির উৎস, শরীর গরম রাখতে সহায়ক, আয়রন ও খনিজ উপাদান থাকে, শীতে দুর্বলতা ও ক্লান্তি কমাতে সাহায্য করে, গ্রামবাংলায় অনেকেই একে শীতের ‘টনিক’ বলে থাকেন।
ঝুঁকি ও সতর্কতা : সব উপকারের পাশাপাশি কিছু সতর্কতার জায়গাও আছে। কাঁচা, না ফুটানো রস থেকে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। অতিরিক্ত চিনি থাকায় ওজন বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। সংরক্ষণ ঠিক না হলে দ্রুত বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে।
বিকল্প কী : যারা ঝুঁকি নিতে চান না, তাদের জন্য বিকল্প আছে। খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে তৈরি পাটালি বা ঝোলা গুড় খেতে বেশ সুস্বাদু। ফুটানো রস ঠান্ডা করে পান করতে পারেন। এই উপায়গুলো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও দীর্ঘদিন ব্যবহারযোগ্য। খেজুরের রস নিঃসন্দেহে শীতের এক অনন্য উপহার। তবে আবেগের চেয়ে সচেতনতা জরুরি। কাঁচা খেজুরের রস খেতে হলে তার উৎস, প্রক্রিয়া ও পরিমাণ; সবকিছুই জানতে হবে। না হলে শীতের এই মিষ্টি বিলাসই হয়ে উঠতে পারে অযাচিত ঝুঁকি।