ঢাকা রোববার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি সুবাস ছড়াচ্ছে

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি সুবাস ছড়াচ্ছে

পুরান ঢাকার নামটি উচ্চারিত হলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে ঐতিহ্য, ইতিহাস আর জন- জীবন ঘনিষ্ঠ এক শহরের ছবি। আধুনিক ঢাকার গোড়াপত্তন হয়েছিল এই পুরান ঢাকাকে কেন্দ্র করেই। সেই পুরান ঢাকার অসংখ্য ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম এক স্বতন্ত্র নাম ‘বাকরখানি’। জনবহুল শহরের পাশাপাশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় পুরান ঢাকা পেরিয়ে এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি হচ্ছে বাকরখানি। রাজশাহী, বরিশাল, দিনাজপুর এবং রংপুর শহরেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বাকরখানি তৈরি করছেন এবং বিপুল চাহিদা থাকায় বিক্রি বাড়ছে।

একসময় পুরান ঢাকার মানুষের সকাল শুরু হতো গরম চা আর মচমুচে বাকরখানি দিয়ে। সময়ের স্রোতে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও বাকরখানি আজও পুরান ঢাকার সংস্কৃতির জীবন্ত সাক্ষর হয়ে টিকে আছে। এখনও বহু মানুষের সকালের নাশতায় এই ঐতিহ্যবাহী রুটির উপস্থিতি চোখে পড়ে।

যদিও ইতিহাসের বিচারে বাকরখানির জন্ম সুদূর আফগানিস্তান বা মধ্য এশিয়ার কোনো অঞ্চলে তবুও পুরান ঢাকার জীবনধারার সঙ্গে এটি এমনভাবে মিশে গেছে যে আজ বাকরখানি ঢাকার নিজস্ব ঐতিহ্য হিসেবেই পরিচিত। এই জনপ্রিয়তা ও ঐতিহ্যের প্রতি মুগ্ধ হয়েই কবি অতুল প্রসাদ সেন তার কবিতায় বাখরখানির কথা উল্লেখ করেছেন- আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাখরখানি/বেচো না বেচো না বন্ধু, তোমার চোখের মণি/কলা বেচো কয়লা বেচো/বেচো মটরদানা বুকের জ্বালা বুকেই জ্বলুক, কান্না বেচোনা।

বাকের ও খনি বেগমের প্রেমে জন্ম নেওয়া বাকরখানি : ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে জানা যায়, বাকরখানির উৎপত্তি ও নামকরণের পেছনে রয়েছে এক করুণ ও অমর প্রেমকাহিনি। আগা বাকের নামে তুর্কিস্তান থেকে আগত এক বালক ক্রীতদাস হিসেবে বাংলায় আসেন। তৎকালীন বাংলার সুবেদার নবাব মুর্শিদকুলি খান তার বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকে দত্তক গ্রহণ করেন এবং লেখাপড়ার পাশাপাশি সমরবিদ্যায় দক্ষ করে তোলেন। পরবর্তীকালে আগা বাকের চট্টগ্রামের ফৌজদার নিযুক্ত হন এবং দীর্ঘ সময় বাকলা, চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলের শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নামানুসারেই বর্তমান বরিশাল জেলার পূর্বনাম হয়েছিল বাকেরগঞ্জ। এই সময় আগা বাকের প্রেমে পড়েন সুন্দরী নর্তকী খনি বেগমের। কিন্তু এই প্রেমের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ান তৎকালীন নগর কোতোয়াল জয়নাল খাঁ। প্রেমের এই দ্বন্দ্ব ভয়াবহ পরিণতির দিকে গড়ায়। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আগা বাকেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে তিনি বাঘকে হত্যা করে বীরের মতো ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে জয়নাল খাঁ খনি বেগমকে অপহরণ করে দুর্গম চন্দ্রদ্বীপে পালিয়ে যান। শেষপর্যন্ত পরাজিত অবস্থায় জয়নাল খাঁ খনি বেগমকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। প্রিয়তমাকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান আগা বাকের তার ভালোবাসার স্মৃতি অমর করে রাখতে এক বিশেষ ধরনের শুকনো রুটি তৈরি করান। নিজের নাম ‘বাকের’ ও প্রেয়সী ‘খনি বেগম’-এর নাম মিলিয়ে এর নামকরণ করেন ‘বাকেরখনি’, যা কালক্রমে মানুষের মুখে মুখে হয়ে ওঠে ‘বাকরখানি’। পুরান ঢাকার প্রখ্যাত লেখক নাজির হোসেন তার কিংবদন্তির ঢাকা গ্রন্থেও এই কাহিনির উল্লেখ করেছেন।

হরেক রকমের বাকরখানি : সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাকরখানিও রূপ বদলেছে। আজ পুরান ঢাকার অলিগলিতে পাওয়া যায় নানা স্বাদের ও ধরনের বাকরখানি। এর মধ্যে নোনতা বাকরখানি সবচেয়ে জনপ্রিয়—মচমুচে আর চায়ের সঙ্গে ডুবিয়ে খাওয়ার জন্য আদর্শ। মিষ্টিপ্রিয়দের জন্য রয়েছে চিনি বা গুড় দিয়ে তৈরি মিষ্টি বাকরখানি। ঢাকাই পনির দিয়ে তৈরি পনিরের বাকরখানি স্বাদে তুলনামূলকভাবে ক্রিমি ও সমৃদ্ধ। অতিরিক্ত ঘি দিয়ে ভাজা ঘি বাকরখানি কিংবা মিষ্টি ঘি বাকরখানি উৎসবের সময় বিশেষ কদর পায়। ঝালপ্রিয়দের জন্য রয়েছে ঝাল বাকরখানি। যেখানে কিমা বা ঝুরা মাংস ব্যবহার করা হয়। বিশেষত কোরবানির সময় যার চাহিদা বাড়ে। এ ছাড়া খাস্তা, কালোজিরা, কিমা কিংবা কাবাব যুক্ত বাকরখানিও পুরান ঢাকার খাবারের বৈচিত্র্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া বাকরখানি : সময় ও আধুনিকতার প্রভাবে বাকরখানিতেও এসেছে পরিবর্তন। একসময় ভোরের পুরান ঢাকার দোকানে সীমাবদ্ধ থাকা এই খাবার এখন প্যাকেটজাত ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য রূপে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। বড় বেকারি, যান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা, সুপারশপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বাকরখানি পৌঁছে গেছে নতুন ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে। স্বাস্থ্যসচেতন ভোক্তাদের জন্য কম তেল বা কম ঘিযুক্ত সংস্করণও তৈরি হচ্ছে। তবে আধুনিক মোড়ক ও নতুন স্বাদের ভিড়ে অনেক সময় পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্বাদ ও কারিগরি দক্ষতা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দেয়। তবুও ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এই সহাবস্থানই বাকরখানিকে শুধু একটি খাবার নয় বরং পুরান ঢাকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত প্রতীকে পরিণত করেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত