ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

স্বর্ণ বন্ধকি ব্যবসায় সর্বস্বান্ত মানুষ

স্বর্ণ বন্ধকি ব্যবসায় সর্বস্বান্ত মানুষ

পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে বাহারি রকমের স্বর্ণের অলঙ্কার একটি ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যের ওপর আঘাত হানেছে জুয়েলারি ব্যবসার আড়ালে সুদ ব্যবসায়ীরা। গ্রাহকে নানা প্রলোভনে একবার স্বর্ণ বন্ধকি ব্যবসায় আটকাতে পারলেই জুয়েলারি ব্যবসায়ীর লাভের ওপর লাভ।

লালবাগ কেল্লা ও বংশাল এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বিশেষ করে ২০২০ সালে করোনা মহামারি আকার ধারণ করায় পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের ভেতর স্বর্ণ বন্ধক রাখার প্রবণতা বেড়েছে। এই সুযোগে সুদ ব্যবসায়ী স্বর্ণ বন্ধক নিয়ে রমরমা ব্যবসা করছেন।

পুরান ঢাকার পাশাপাশি দেশের সর্বত্র জুয়েলারি ব্যবসার আড়ালে অবাধে চলছে স্বর্ণ বন্ধকি অবৈধ সুদ ব্যবসা। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, বংশাল, লালবাগ কেল্লা, বাইতুল মোকাররম, মৌচাক মার্কেট থেকে শুরু করে অভিজাত গুলশান, বনানী ও উত্তরাসহ সব এলাকাতেই স্বর্ণ বন্ধকি রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর বাইরেও দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় বে-আইনিভাবে স্বর্ণ বন্ধকী ব্যবসার বিস্তার লাভ করেছে। আর্থিক সংকটের কারণে জেনে-শুনেও শখের অলঙ্কার বন্ধক রেখে সর্বশান্ত হচ্ছেন মধ্যবৃত্ত ও দরিদ্র মানুষ।

জানা গেছে, দেশে স্বর্ণ বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার কোনো আইনগত ভিত্তি নাই। তবে এই খাত থেকে চড়া হারে সুদ আদায় করা হচ্ছে, মাসিক সর্বনিম্ন ৪ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের ব্যবসার ফাঁদে পড়ে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে বহু মানুষ হারাচ্ছেন তাদের শেষ সম্বল।

তথ্যমতে, ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ক্যারেট বিবেচনা করে দ্বিগুণ স্বর্ণ বন্ধক রেখে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। গ্রাহকদের কাছ থেকে দোকানিরা বিভিন্ন ধরনের তথ্য নেন। স্বর্ণের অলঙ্কার বন্ধন রাখার ফাঁদে এক বার পড়লে সেখান থেকে বের হয়ে আসা দুষ্কর হয়ে পড়ে।

তাঁতীবাজারে কয়েকটি জুয়েলার্স দোকান ঘুরে দেখা গেছে, দোকানে স্বর্ণ বন্ধক রেখে সুদে টাকা দেওয়া দেন। লাখে ৪ শতাংশ সুদ নেওয়া হয়। সময় ভেদে সুদের মাত্রা কমবেশি হয়ে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে জুয়েলার্স দোকানে কর্মরত এক ব্যক্তি বলেন, স্বর্ণ বন্ধক রেখে সুদে টাকা দেওয়া হয়। এটি একদিনে হয় নি, যুগের পর যুগ ধরে স্বর্ণ অলঙ্কার বন্ধ রেখে সুদে টাকা দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, যারা স্বর্ণ অলঙ্কার রেখে সুদে টাকা নিতে আসেন তাদের কাছ থেকে স্থায়ী, অস্থায়ী ঠিকানা এবং জাতীয় পরিচয়পত্র রাখা হয়। আর আমাদের সিরিয়াল নাম্বার থাকে, ঋণের বিপরিতে কোড নাম্বার থাকে। ৩-৪ ধরনের খাতায় তাদের তথ্য লিখে রাখতে হয়। মাসে মাসে সুদের টাকা পরিশোধ করতে হয়। মাসের সুদ মাসে দিয়ে যেতে পারলে যতদিন খুশি স্বর্ণ বন্ধক রাখতে পারে, টাকা রাখতে পারেন। একটানা তিন মাস সুদের টাকা দিতে না পারলে আমরা গ্রাহকদের জানাই। এরপর স্বর্ণ ভেঙে অন্য অলঙ্কার তৈরি করে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে দেই।

পুরান ঢাকার পাশাপাশি রাজধানীর মৌচাক মার্কেটের দোতলায় জুয়েলার্সের দোকানিরা বলেন, স্বর্ণ বন্ধক নিয়ে স্বর্ণের ক্যারেট হিসাব করে লাখে ৪ শতাংশ হারে সুদে ঋণ দেওয়া হয়। একই মার্কেট থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী বলেন, ক্যারেট বিবেচনা করে আমরা টাকা দেই। এটি ক্ষেত্র বিশেষে স্বর্ণের বাজার দামের ওপর ওঠানামা করে। সাধারণত অর্ধেক দাম দেওয়া হয় কারণ আমাদের হাতে কিছু টাকা রাখতে হয়। আর সুদ নেওয়া হয় ৩-৪ শতাংশ হারে। এটা লাখে হিসাব। দায়ে পড়ে অনেকের মতো মৌচাক জুয়েলারি মার্কেটে স্বর্ণ বন্ধক রেখে সুদে ঋণ নিতে আসেন সুহাইল আহমেদ। তিনি জানান, আমার ছোট একটা ব্যবসা আছে। ব্যবসাটা আরেকটু বড় করার জন্য টাকা প্রয়োজন। কাছে নগদ টাকা না থাকায় স্ত্রীর স্বর্ণের চেন ও আংটি বন্ধক রাখতে এসেছি। এগুলো ২১ ক্যারেটের সোনা। কিন্তু তারা অর্ধেকেরও কম টাকা দিতে চায়। এখনও স্বর্ণ বন্ধক রাখি নি। যেখানে একটু বেশি দাম পাবো সেখানে রাখব। দুটি দোকানে আমার কাছে ৪ শতাংশ হারে সুদ চেয়েছে। স্বর্ণ বন্ধক রেখে টাকা নিতে কি কি কাগজ জমা দিতে হবে বললে তিনি জানান, ভোটার আইডি কার্ডের সঙ্গে ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স ও স্থায়ী-অস্থায়ী ঠিকানার প্রমাণপত্র চেয়েছে।

তাঁতীবাজার থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, স্বর্ণ বন্ধক রেখে সুদে টাকা নিয়েছি। এখন সুদ দিতে কষ্ট হচ্ছে। স্বর্ণের দোকান থেকে ফোন দিয়েছিল তাই দেখা করতে এসেছি।

জানা যায়, ১৯৮৭ সালের ভোগ্যপণ্য আইনে স্বর্ণের ব্যবসার লাইসেন্সের কথা বলা থাকলেও, তাতে বন্ধক বা সুদে টাকা দেওয়ার বিধান নাই। কিন্তু আইন না মেনে অবৈধভাবে বন্ধকি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বহু প্রতিষ্ঠান।

স্বর্ণ বন্ধকি ব্যবসার বিষয় ঢাকা জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ বলেন, স্বর্ণের ব্যবসা করার জন্য আমাদের অফিস থেকে ডিলিং লাইসেন্স দেওয়া হয়। তবে স্বর্ণ বন্ধক নিয়ে সুদের ব্যবসার জন্য কোনো লাইসেন্স দেওয়া হয় না। যথাযথ তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত