ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইসলামে নেতা নির্বাচন ও নেতৃত্বের গুরুত্ব

মুফতি কাজী সিকান্দার
ইসলামে নেতা নির্বাচন ও নেতৃত্বের গুরুত্ব

আমির, নেতা বা দলপতি। যিনি একটি দল, একটি সমাজ বা একটি রাষ্ট্রের পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন। আমির বা নেতার মত, ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা জাতির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নেতা যদি জালেম হয় তখন তার প্রজারা জুলুমের শিকার হবে। আর নেতা যদি দয়ার্দ্র হয় তবে সমাজে শান্তি বিরাজ করবে। নেতার একার ভুলের মাশুল দিতে হবে পুরো জাতিকে। তাই নেতা বানানোর ক্ষেত্রে বিচক্ষণ হতে হবে জনগণকে। নেতার গুণাবলি যাচাই করে নেতা নির্বাচন করতে হবে। নেতার গুণাবলির মধ্যে রয়েছেÑ

নেতা কঠিন হবে না : আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, ‘হে নবী! আপনি যদি কর্কশভাষী, রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর স্বভাবের হতেন তবে লোকেরা আপনার আশপাশ ছেড়ে তারা চলে যেত।’ (সুরা ইমরান : ১৫৯)।

নেতা স্নেহশীল হবে : নবী করিম (সা.) এর বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, ‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসুল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তাঁর পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মোমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’ (সুরা তাওবাহ : ১২৮)।

নেতা ধৈর্যশীল হবে : কোরআন মজিদে আরও এরশাদ হয়েছে, ‘তারা ক্ষতিগ্রস্ত নয় যারা ঈমান আনে, সৎকাজ করে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্য ধারণে পরস্পরকে উদ্বুদ্ধ করে।’ (সুরা আসর : ৩)।

নেতা হিতাকাক্সক্ষী হবে : হজরত জাবের (রা.) বলেন, ‘সাহাবা (রা.) আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সাকিফ গোত্রের তিরগুলো আমাদের শেষ করে দিল। আপনি তাদের জন্য বদদোয়া করুন। তিন এরশাদ করেন, আয় আল্লাহ সাকিফ গোত্রকে হোদায়ত দান করুন।’ (তিরমিজি : ৩৯৪২)।

নেতা পরামর্শ করে চলবে : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) অপেক্ষ অধিক নিজের সাথিদের সঙ্গে পরামর্শ করতে আমি কাউকে দেখিনি।’ (তিরমিজি : ১৭১৪)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি পরামর্শ করে, সে সোজা পথের ওপর থাকে। আর আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি পরামর্শ করে না সে চিন্তাযুক্ত থাকে।’ (বায়হাকি : ৬/৭৬)।

নেতা সুসংবাদ শুনাবে : হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, লোকদের সঙ্গে সহজ আচরণ কর এবং তাদের সঙ্গে কঠিন আচরণ করো না। সুসংবাদ শুনাও এবং তাদের বিমুখ করবে না।’ (বোখারি : ৬৯)।

নেতৃত্বের লোভ থাকবে না : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমরা নেতৃত্বের লোভ পোষণ কর, অথচ কেয়ামতের দিন তা লজ্জার কারণ হবে। কতই উত্তম দুগ্ধদায়িনী এবং কতই না মন্দ পানে বাধাদানকারিণী।’ (অর্থাৎ নেতৃত্বের শুরু দুধ পান করার মতো আর শেষ দুধ ছাড়ার মতো কষ্টকর)। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কসম! আমরা এসব বিষয়ে এমন কোনো ব্যক্তিকেই নেতা বানাব না, যে নেতা চায় অথবা তার খায়েশ রাখে।’ (মুসলিম : ৪৭১৭)।

সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজে নিষেধ করবে : হজরত জারির বিন আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো কওম বা জামাতের মধ্যে কোনো ব্যক্তি কোনো গোনাহের কাজে লিপ্ত হয় এবং ওই কওম বা জামাতের মধ্যে শক্তি থাকা সত্ত্বেও তাকে ওই গোনাহ থেকে বাধা না দেয়, তাহলে মৃত্যুর আগে দুনিয়াতেই তাদের ওপর আল্লাহর আজাব এসে যায়।’ (আবু দাউদ)।

নেতার জন্য হুঁশিয়ারি : হজরত মা’কেল ইবনে ইয়াসার (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.) কে এরশাদ করতে শুনেছি, যে নেতা মুসলমানদের বিষয়গুলোর জিম্মাদার হয়ে মুসলমানদের কল্যাণ কামনায় চেষ্টা করবে না, সে মুসলমানদের সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (মুসলিম : ৪৭৩১)।

অবৈধ ও জালেম নেতার শাস্তি : হজরত আ’কেল ইবনে ইয়াসার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলমান জনগোষ্ঠীর নেতা হয়, অতঃপর তাদের সঙ্গে প্রতারণামূলক কাজ করে এবং ওই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তবে আল্লাহ তায়ালা তার ওপর জান্নাতকে হারাম করে দেবেন।’ (বোখারি)। হজরত আবু মারইয়াম আযদি (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.) কে এরশাদ করতে শুনেছি, যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের কোনো কাজের নেতা বানিয়েছেন, আর সে মুসলমানদের অবস্থা, প্রয়োজনগুলো ও তাদের অভাব-অনটন থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তার অবস্থা ও প্রয়োজনগুলো এবং অভাব-অনটন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।’ (আবু দাউদ : ২৯৪৮)।

রাসুল (সা.) এর দোয়া ও বদদোয়া : হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমার এ ঘরে রাসুল (সা.) কে দোয়া করতে শুনেছি যে, আয় আল্লাহ! যে ব্যক্তি আমার উম্মতের যে কোনো কাজের দায়িত্বশীল নিযুক্ত হয়, অতঃপর সে লোকদের কষ্টের মধ্যে ফেলে, আপনিও তাকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিন। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মতের যে কোনো বিষয়ে দায়িত্বশীল নিযুক্ত হয় এবং লোকদের সঙ্গে নম্র ব্যবহার করে আপনিও তার সঙ্গে নম্র ব্যবহার করুন।’ (মুসলিম : ৪৭২২)।

যোগ্য লোককে নেতা না বানালে : হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে দলের নেতা নিযুক্ত করল; কিন্তু দলে তার চেয়ে বেশি আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্টকারী ব্যক্তি রয়েছে, সে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে খেয়ানত করল, রাসুল (সা.) এর সঙ্গে খেয়ানত করল এবং ঈমানদারদের সঙ্গে খেয়ানত করল।’ (মুসতাদরাকে হাকিম ৪/৯২)।

নেতার আনুগত্য করা : হজরত উম্মে হোসাইন (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যদি তোমাদের ওপর কোনো নাক-কান কাটা গোলামকেও নেতা নিযুক্ত করা হয়, যে তোমাদের আল্লাহ তায়ালার কিতাব বা হুকুম মোতবেক চালায়, তোমরা তার কাথা শুনবে এবং মানবে।’ (মুসলিম : ৪৭৬২)। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, নেতার কথা শুনতে ও মানতে থাক, যদিও তোমাদের ওপর এমন হাবশি গোলামকেই নেতা নিযুক্ত করা হোক না কেন, যার মাথা দেখতে কিশমিশের মতো (ছোট) হয়।’ (বোখারি : ৭১৪২)।

লেখক : পরিচালক, মারকাযুদ দ্বীন আল ইসলামী ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত