ঢাকা শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মেরাজ থেকে উম্মতের জন্য উপহার

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
মেরাজ থেকে উম্মতের জন্য উপহার

মেরাজ মানে ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণ। এই পরিভ্রমণের ব্যবস্থা করেন স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। এই অলৌকিক সফরের সন-তারিখ নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও মূল ঘটনা সম্পর্কে কারও দ্বিমত নেই। মেরাজ হয়েছিল হিজরতের আগে আর প্রচলিত মত অনুযায়ী হিজরতের ১ বছর আগে, তারিখ ছিল ২৭ রজব, রাতের কিছু অংশে। কোরআন মজিদের সুরা বনি ইসরাইল ও সুরা নাজমে মেরাজের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। বিপুল সংখ্যক হাদিসে তার বিশদ বিবরণ রয়েছে। কাজেই মেরাজ অস্বীকার করলে কেউ মুসলমান থাকবে না। বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, মহানবী (সা.) এর মেরাজ সশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায় হয়েছে, আত্মিকভাবে কল্পনার ডানায় ভর করে বা স্বপ্নযোগে হয়নি।

মেরাজের তিনটি ধাপ। প্রথম ধাপে প্রিয় নবীজি খোদায়ি ব্যবস্থাপনায় মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত মসজিদুল আকসায় গমন করেন। এর বর্র্ণনা সুরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে আছে। দ্বিতীয় ধাপে ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও সপ্তম আসমান পাড়ি দিয়ে নবীজি নিম্নজগতের প্রান্তসীমা ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’য় উপনীত হন। ৬ষ্ঠ বা ৭ম আসমানে সিদরাতুল মুনতাহা ও নিকটে জান্নাতুল মাওয়ায় অবস্থানের কথা উল্লেখ আছে সুরা নাজমের ১-১৮ আয়াতে। মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে বেহেশত-দোজখ পরিদর্শন পর্যন্ত সফরসঙ্গী বা গাইড ছিলেন ওহিবাহক ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)। তৃতীয় ধাপে জিবরাইল বিদায় নেন এবং নবীজি একাকী আল্লাহর সন্নিধানে গমন করেন।

তিনি আল্লাহ তায়ালাকে স্বচক্ষে দেখেছেন কী দেখেননি তা নিয়ে মতপার্থক্য জটিল। একটি মত হচ্ছে, আল্লাহকে মোমিনরা আখেরাতে দেখবে। দুনিয়ায় চর্মচক্ষে আল্লাহর দিদার অসম্ভব, কোরআনের মানা। কাজেই নবীজি মেরাজে আল্লাহ তায়ালাকে দেখেননি। এটি অসম্ভব। আরেকটি মত হচ্ছে, এই দেখা তো হয়েছে ঊর্ধ্বজগতে। আখেরাত বলতে তো সেই জগৎকেই বোঝায়। আখেরাতে তো মোমিনরা আল্লাহ তায়ালাকে পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্যোতির্ময় দেদীপ্যমান দেখতে পাবেন। তাহলে মেরাজে গিয়ে আল্লাহকে দেখতে আপত্তি কোথায়? হাদিস ভিত্তিক আলোচনা ও বিতর্কগুলো বেশ দীর্ঘ ও গভীর। বিজ্ঞজনের মত হচ্ছে, এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়সালায় বিতর্কে এড়িয়ে মেরাজের শিক্ষাগুলো হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করাই উত্তম ও সবচেয়ে নিরাপদ।

আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মহানবী (সা.) আল্লাহর সন্নিধান থেকে আমাদের জন্য কী এনেছেন বা আল্লাহ তায়ালা মেরাজে নিয়ে নবীজিকে (সা.) উম্মতের জন্য কি অমূল্য উপহার দিয়েছেন। মুসলিম শরিফে আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা.) এর বর্ণনায় তিনটি উপহারের কথা উল্লেখ আছেÑ (১) পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, (২) সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, (৩) আল্লাহর সঙ্গে শিরক না করলে অন্যান্য গোনাহ মাফ হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কিত ঘোষণা। মুসলিম শরিফে মেরাজের বিশদ বিবরণ সংবলিত সাবেত আল বুনানীর বর্ণনায় আরেকটি উপহারের উল্লেখ আছে এভাবেÑ (৪) যে ব্যক্তি কোনো সৎকর্ম করার মনস্থ করবে কাজটি বাস্তবায়ন করার আগেই তার জন্য একটি সওয়াব লিখে দেওয়া হবে। আর সে সংকল্প বাস্তবায়ন করলে দেওয়া হবে দশগুণ সওয়াব। আর যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজ করার মনস্থ করবে, যতক্ষণ সে কাজটি না করবে, ততক্ষণ তার জন্য কোনো গোনাহ লেখা হবে না। যদি সে কাজটি করে বসে, তবে তার জন্য একটি গোনাহ লেখা হবে। (৫) আল্লামা রশীদ উদ্দীন মাইবেদী প্রণীত তাফসিরে কাশফুল আসরারে আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসুলের মাঝে একটি সংলাপের প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে। সেই সংলাপ হলোÑ ‘আত্তাহিয়াত’, যা আমরা প্রাত্যহিক নামাজে পড়ে থাকি। অবশ্য এ সম্পর্কিত হাদিসের ভাষ্যটি আমার অজানা।

আমরা মানসচক্ষে ভেবে দেখি, সমগ্র সৃষ্টির প্রতিনিধি হয়ে প্রিয় রাসুল আল্লাহর সমীপে উপনীত হয়েছেন আর আল্লাহ তায়ালা আপন হাবিবকে সমগ্র মানবকুলের জন্য উপহার দিচ্ছেন। কী হতে পারে এই নিবেদন ও উপহারের ধরন! আমরা তো উপহার বলতে বুঝি মিষ্টান্নের প্যাকেট, ফলমূল কিংবা মূল্যবান গহনা। তাহলে উল্লেখিত পাঁচ আইটেমের মধ্যে কি অমূল্য রতœ লুকায়িত থাকতে পারে। পার্থিব উপহারে উদ্দেশ্য থাকে আত্মীয় বা বন্ধুদের মাঝে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা। গভীর পর্যালোচনায় দেখা যাবে মেরাজের অনন্য উপহারের মধ্যেও রয়েছে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে গভীর সম্পর্ক, বন্ধন ও ভালোবাসা বৃদ্ধির সওগাত।

মহানবীর নবুয়ত লাভের পরপর ফরজ হয়েছিল ইসলামের প্রধান বিধান ফজর নামাজ, মতান্তরে আসরের নামাজ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়েছে মেরাজের রাতে। এর প্রক্রিয়া ছিল বেশ চমৎকার ও গভীর তাৎপর্যময়। উম্মত দৈনিক ৫০ বার আল্লাহর সমীপে হাজির হতে পারবে, এই উপহার নিয়ে নবীজি খুশিমনে চলে আসছিলেন আরশ থেকে। ৬ষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.) পথ আগলে জিজ্ঞাসা করলেন, কী পেলেন, কী নিয়ে যাচ্ছেন? নবীজি বললেন, দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজ। মুসা (আ.) বললেন, আপনি গিয়ে সংখ্যা কমিয়ে নিন, দৈনিক ৫০ বেলা নামাজ আদায় করতে পারবে না আপনার উম্মত। মহানবী ফিরে গেলেন আল্লাহ পাকের সন্নিধানে। বলা হলো, তাহলে ৪০ বার। ফিরে আসতে মুসা (আ.) আবারও জিজ্ঞাসা করলেন। হজরত (সা.) বললেন, ৪০ বার পেয়েছি। তিনি বুঝিয়ে বললেন, আমি বনি ইসরাইলকে নিয়ে অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। আপনিও পারবেন না, ফিরে যান, কমিয়ে আনুন। এভাবে প্রতিবারে ১০ ওয়াক্ত করে আর শেষবারে পাঁচ ওয়াক্তে কমানো হলো নামাজ। মুসা (আ.) এবারও ফিরে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন।

নবীজি বললেন, আমার আর যেতে লজ্জা লাগে। তখন গায়েবিভাবে ঘোষণা আসে, যারা এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে তাদের ৫০ ওয়াক্তের সওয়াব দেওয়া হবে। নামাজ আল্লাহর সঙ্গে বান্দার গভীর সম্পর্কের প্রাত্যহিক অনুশীলন। নামাজের মূল অঙ্গ সুরা ফাতেহা পাঠের সময় আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সরাসরি কথোপকথনের যে বর্ণনা মুসলিম শরিফে আছে তা নামাজের আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যের সাক্ষী।

মেরাজের পঞ্চম উপহার আত্তাহিয়াতের মধ্যেও প্রথমভাগ আল্লাহর সমীপে নবীজির সালাম নিবেদন, তারপর আল্লাহর পক্ষ থেকে সালামের জবাব, এর পর নবীজির সালাম গ্রহণ আর নবীজি ও আল্লাহর মাঝে এই সংলাপ শুনে আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের সাক্ষ্যদান। নামাজের শেষভাগে আত্তাহিয়াত পাঠও প্রমাণ করে, নামাজ আসলে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে সম্পর্ক ও বন্ধনের অনুশীলন। নামাজের মানসিক, নৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত সুফলগুলো বাড়তি পাওনা মাত্র। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের এই অতুলনীয় গুরুত্ব উম্মত যাতে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে সে জন্যই মেরাজে নিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তা ফরজ করা হয়েছে। নতুবা সাধারণ ওহির সূত্রে নির্দেশ এলেও তা ফরজ হয়ে যেত।

মেরাজে নাজিলকৃত সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের মহিমাও অপরিসীম। হাদিসে বলা হয়েছে, এ হচ্ছে আল্লাহর আরশের নিচের দুটি ভান্ডার। প্রথম আয়াতে সব নবী-রাসুলের (আ.) প্রতি বিশ্বাস ও সম্মানবোধের সূত্রে বিশ্বসভ্যতার সঙ্গে একাত্মতা আর শেষ আয়াতে মহামহিম আল্লাহর কাছে সমর্পিত ও সমাহিত হওয়ার ফর্মুলা। সাধারণ দৃষ্টিতে সমাজ ব্যবস্থায় বড় বড় লোকের সঙ্গে যার আত্মীয়তা বা বন্ধুত্ব তাকে সমীহ ও সম্মান করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব সভ্যতার রূপকার নবী রাসুলদের সঙ্গে আত্মীয়তা ও বন্ধুত্ব গড়ে তোলার বন্ধন কী হতে পারে? চিন্তা করুন, তারা অনেক আগেই দুনিয়া থেকে চলে গেছেন, আমরা যদি তাদের প্রতি বিশ্বাস ও সম্মানবোধ পোষণ করি তাহলে তাদের সঙ্গে ঈমানের একটি আত্মীয়তা গড়ে উঠবে। আর যদি তারা যা বিশ^াস করতেন এবং বাস্তব জীবনে আমল করতেন তা আমাদের জীবনে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিই তাহলে তারা অলক্ষ্যে আমাদেরকে ভালোবাসবেন। কেয়ামতের দিন সেই ভালোবাসা সুপারিশে রূপান্তরিত হবে এবং আমাদের নাজাতের উসিলা হবে। ইহজগতেও আমাদের জন্য সৎকাজের প্রেরণা ও অনুঘটকের কাজ দেবে। সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের অতুলনীয় ফজিলত এবং বেহেশতের ভান্ডার হওয়ার বিষয়টিকে আমরা এভাবে বোঝার চেষ্টা করতে পারি।

সৎকর্ম সম্পাদনের আগেই শুধু ভালো চিন্তার বিনিময়ে একটি করে সওয়াব দেওয়ার ঘোষণা উম্মতের জন্য সর্বোচ্চ উপহার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আধুনিক মালয়েশিয়ার অভাবনীয় উন্নতি মাহাথির মুহাম্মদের দ্বারা কীভাবে সম্ভব হলো, তার ওপর বিশ্লেষণমূলক একটি লেখা পড়েছিলাম বছর দুয়েক আগে। মাহাথির মুহাম্মদ নাকি তার জাতি তরুণদের বলেছিলেন, প্রত্যেকে প্রতিদিন ভালো ভালো যাকিছু চিন্তা কর, ডায়েরিতে লিখে রাখ, তার বাস্তবায়ন একদিন হবেই। তার আহ্বানে তরুণরা যখন ডায়েরি লেখা শুরু করল মনের অজান্তেই তাদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাতে হলো। প্রতিদিনের ভালো ভালো চিন্তাগুলো জমা হয়ে ব্যক্তির নিজের মনোজগতে এবং তরুণ সমাজে চিন্তা ও সৃজনশীল সৎকর্মের উজ্জীবন ঘটাল। আসলে চিন্তাই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে জাতির প্রতিটি সদস্য সৎ ও ভালো চিন্তায় অভ্যস্ত হবে, সে জাতির উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। মেরাজের আলোচ্য উপহার আমাদের সেই উন্নতির পথে, আল্লাহর সান্নিধ্যের পানে, পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফার দায়িত্ব পালনের চেতনায় উজ্জীবিত করুক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত