একজন মুসলিমের জীবনে মহামূল্যবান সম্পদ হলো ঈমান। দেহের মধ্যে আত্মা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্য ঈমানও তেমন গুরুত্বপূর্ণ। ঈমান হলো সৌভাগ্য ও সাফল্যের ভিত্তি। মানুষ ইহকালীন জীবনে যত ইবাদত-বন্দেগি ও সৎকর্ম করে থাকেন সব কিছু আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার শর্ত হলো ঈমান। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো তথা আল্লাহ, নবী-রাসুল, ফেরেশতা, আখেরাত ও তকদির ইত্যাদি বিষয়কে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা ও সে অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করাই হলো ঈমান। যে ব্যক্তি এসব বিষয়কে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তাকে বলা হয় মোমিন।
ঈমানের পরিচয় : ঈমান আরবি শব্দ ‘আমনুন’ শব্দ থেকে নির্গত। এটি বাবে ‘সামিআ’ থেকে ব্যবহৃত হলে অর্থ হবে বিশ্বস্ত হওয়া, নির্ভরযোগ্য হওয়া। সুতারাং ঈমানের শাব্দিক অর্থ হলো বিশ্বাস করা, ভয়ভীতি মুক্ত হওয়া, নির্ভর করা, অন্তরে প্রশান্তি লাভ হওয়া। আল্লামা আবুল হুসাইন ইবনুল ফারিস (মৃত্যু-৩৯৫ হি.) বলেন, ‘আমনুন’ মূল ধাতুটির প্রথম অর্থ হলো বিশ্বস্ততা যা খেয়ানতের বিপরীত। অপরটি হলো কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের সত্যতা স্বীকার করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ঈমান হলো হজরত রাসুলে করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন তাতে বিশ^াস স্থাপন করা, মুখে স্বীকৃতি দেওয়া ও কাজে বাস্তবায়ন করা। হাদিসে পাকে রয়েছে একদা আবদুল কায়স গোত্রের প্রতিনিধি দল প্রিয় নবীজির দরবারে আগমন করেন। তাদের প্রসঙ্গে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনার নির্দেশ প্রদান করেন এবং বলেন, তোমরা কি জানো ইমান কী? তারা বলল, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, ঈমান হলো তুমি সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আর মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসুল। আর নামাজ কায়েম করা, জাকাত প্রদান করা, রমজান মাসের রোজা পালন করা ও গনিমতের মালের এক-পঞ্চমাংশ আদায় করা। (বোখারি-৫১)।
অপর হাদিসে রয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদিন রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লোকজনের মধ্যে ছিলেন। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি (জিবরাইল আ. মানুষের আকৃতি নিয়ে এসেছিলেন) তার আগমন করে বললেন, ঈমান কী? তিনি উত্তরে বলেন, ঈমান হলো তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহর ওপর, ফেরেশতাদের, তার পুস্তকগুলোতে, তার সাক্ষাতে, তার রাসুলদের ওপর। তুমি বিশ্বাস স্থাপন করবে পুনরুত্থানের ওপর এবং তকদিরের ওপর।’ প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর বিশ্বাসকেই ঈমান বলা হয়। যেখানে থাকে তিনটি বিষয়ের সমষ্টি। ১) অন্তরে বিশ্বাস ২) মুখে স্বীকৃতি ৩) কাজে বাস্তবায়ন। ঈমানের একটি প্রতিশব্দ হলো ‘তাসদিক’ বা সত্য বলে স্বীকার করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, মোমিন শুধু তারাই যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করেননি। আর নিজেদের সম্পদ ও নিজেদের জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে। এরাই সত্যনিষ্ঠ। (সুরা হুজরাত-১৫)।
ইসলামের পরিচয় : আরবি ভাষায় ইসলাম শব্দটির অর্থ হলো আত্মসমর্পণ করা, অনুগত হওয়া, শান্তির পথে চলা, শরিয়তের হুকুম আহকাম মেনে চলা ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহর অনুগত হওয়া তার পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করা, বিনা দ্বিধায় আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলা এবং তার দেওয়া বিধান অনুসারে জীবন পরিচালনা করাই হলো ইসলাম। ইসলামের পরিচয় সম্পর্কে রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন, ‘ইসলাম হলো তুমি এই কথা সাক্ষ্য দেবে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, হজরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসুল, সালাত আদায় করা, জাকাত প্রদান করা, রমজানের সাওম পালন করা, সামর্থ্য থাকলে বায়তুল্লাহ শরিফ হজ আদায় করা।’
ঈমান ও ইসলামের মধ্যে সম্পর্ক : ঈমানের আধার হলো অন্তর আর ইসলামের আধার হলো শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। ঈমান ব্যতীত ইসলাম ও ইসলাম ব্যতীত ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। ঈমান অন্তর থেকে শুরু হয়ে প্রকাশ্যে আমলে পৌঁছে পূর্ণতা লাভ করে। অর্থাৎ প্রকাশ্যে আমল তথা আনুগত্য ও ইবাদত-বন্দেগি আন্তরিক বিশ্বাসে না হলে গ্রহণযোগ্য হয় না। হজরত মোল্লা আলী কারী (রহ.) বলেন, ঈমান ও ইসলামের সম্পর্ক দেহ ও আত্মার সম্পর্কের মতো। শুধু আমলের নাম ঈমান নয়, অন্যদিকে ঈমানও আমলের নাম নয়। অনেক সময় বিশেষ প্রেক্ষাপটে আমল উঠে যায়। যেমনÑ ঋতুবতী নারীর সালাত। কিন্তু ওই অবস্থায় ওই মহিলার ঈমান উঠে গেছে একথা বলা যায় না। রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি আমাদের মতো সালাত আদায় করে, আমাদের কিবলামুখী হয় আর আমাদের জবেহকৃত প্রাণী খায় সেই মুসলিম। (বোখারি-৩৯১)। অপর হাদিসে তিনি বলেন, প্রকৃত মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে। (বোখারি-১০)।
সহকারী শিক্ষক, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল