কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে ভূগর্ভ থেকে দাব্বাতুল আরদ নামক এক অদ্ভুত জন্তু বের হবে। জন্তুটি মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। এটি হবে কেয়ামতের নিকটবর্তী হওয়ার অন্যতম সর্বশেষ ভয়াবহ আলামত। পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়ার পর তওবার দরজা বন্ধ হয়ে গেলে এটি বের হবে। সহিহ হাদিস থেকে জানা যায়, পশ্চিম আকাশে সূর্য ওঠার কিছুক্ষণ পরই জমিন থেকে এই অদ্ভুত প্রাণীটি বের হবে। তওবার দরজা যে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে এ কথাটিকে চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করার জন্য প্রাণীটি মোমিনদেরকে কাফের থেকে নির্দিষ্ট চিহ্নের মাধ্যমে আলাদা করে ফেলবে। মোমিনের কপালে লিখে দেবে ‘মোমিন’ এবং কাফেরের কপালে লিখে দেবে ‘কাফের’। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন প্রতিশ্রুতি (কেয়ামত) সমাগত হবে, তখন আমি তাদের সামনে ভূগর্ভ থেকে একটি জীব নির্গত করব। সে মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। এ কারণে যে মানুষ আমার নিদর্শনগুলোতে বিশ্বাস করত না।’ (সুরা নামল : ৮২)।
প্রাণীটির কাজ কী হবে এবং কী বিষয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলবে এ ব্যাপারে আল্লামা আলুসি বলেন, আয়াতে উল্লেখিত কোরআনের বাণীটিই হবে তার কথা। ‘ইন্নন নাসা কানু বি আয়াতিনা লা ইউক্বিনুন’ এই বাক্যটি সে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে শোনাবে। মর্ম এই যে, আজকের পূর্বে অনেক মানুষই মহান আল্লাহর আয়াত ও নিদর্শনগুলোতে বিশ্বাস করেনি। বিশেষ করে কেয়ামতের আলামত ও তা সংঘটিত হওয়ার বিষয়ে এমনকি আমার আগমনের বিষয়েও অনেক মানুষ বিশ্বাস করত না। এখন সে সময় এসে গেছে এবং আমিও বের হয়ে এসেছি।
দাব্বাতুল আরদ কী? আরবিতে ‘দাব্বাতুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে জন্তু বা প্রাণী, যা জমিনে পা ফেলে চলাচল করে। আর ‘আরদ’ অর্থ হচ্ছে ভূমি, ভূপৃষ্ঠ বা ভূগর্ভ। কেয়ামতের আগে ভূপৃষ্ঠ থেকে অদ্ভুত ধরনের একটি প্রাণী বের হবে এবং পুরো পৃথিবীতে বিচরণ করবে। মূলত ‘দাব্বাতুল আরদ’ এটি প্রাণীটির নাম নয় বরং অদ্ভুত প্রাণীটির প্রসঙ্গে কোরআনে ব্যবহৃত শব্দ, যার অর্থ ‘ভূগর্ভস্থ প্রাণী’। এটি কেয়ামতের বড় আলামতের অন্যতম একটি। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ওই সময় আসার আগ পর্যন্ত কেয়ামত কায়েম হবে না, যতদিন না পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের ঘটনা সংঘটিত হবে। পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের ঘটনা ঘটার পর মানুষ দাব্বাতুল আরদ দেখতে পাবে।’ (বোখারি : ৪৬৩৬; মুসলিম : ১৫৭)।
সহিহ মুসলিমে হুযাইফাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, একদা রাসুল (সা.) আমাদের কাছে আগমন করলেন। আমরা তখন কিছু আলোচনা করছিলাম, তখন রাসুল (সা.) বলল, তোমরা কি বিষয়ে আলোচনা করছ? তারা বলল, আমরা কেয়ামতের আলামত সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেন, যতদিন তোমরা ১০টি আলামত না দেখবে ততদিন কেয়ামত হবে না। ১. ধোঁয়া, ২. দাজ্জালের আগমন, ৩. ভূগর্ত থেকে নিগর্ত দাব্বাতুল/দাব্বাতুল আরদ নামক অদ্ভুত এক জানোয়ারের আগমন, ৪.পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, ৫. ‘ঈসা ইবনু মারইয়ামের আগমন, ৬. ইয়াজুয-মাজুযের আবর্ভাব, ৭. পূর্বে ভূমিধস, ৮. পশ্চিমে ভূমিধস, ৯. আরব উপদ্বীপে ভূমিধস, ১০. সর্বশেষে ইয়েমেন থেকে একটি আগুন বের হয়ে মানুষকে সিরিয়ার দিকে হাঁকিয়ে নেবে।
দাব্বাতুল আরদের আকৃতি : ‘দাব্বাতুল আরদ’ বা অদ্ভুত প্রাণীটির আকৃতি প্রসঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত আলোচনার পর্যালোচনায় দেখা যায়, এর ভেতর অনেক প্রাণীর বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে। অদ্ভুত এই প্রাণী কিছুটা উটের মতো হবে। পা হবে চারটি। মাথা হবে ষাঁড়ের মতো। চোখ হবে শূকরের মতো। কান হবে হাতির মতো। নাক হবে উটপাখির মতো। বুক হবে সিংহের মতো। রং হবে নেকড়ের মতো। কপাল হবে ভেড়ার মতো। ঘন পশমবিশিষ্ট হবে। মানুষের মতো চেহারা হবে। (ফাতহুল কাদির : ৪/১৫২; আদ-দুররুল মানসুর : ৬/৩৭৮)।
ইমাম কুরতুবী বলেন, এটি হবে সালেহ (আ.) এর উটনীর বাছুর। যখন কাফেররা উটনীকে হত্যা করে ফেলল তখন বাছুরটি পাথরের মাঝে ঢুকে পড়েছিল। এটি আল্লহ তায়ালার অনুমতিক্রমে কেয়ামতের পূর্বে বের হয়ে আসবে। ইমাম কুরতুবি বলেন, এটিই বিশুদ্ধ মত।
কেউ কেউ বলেছেন, এটি হবে দাজ্জালের হাদিসে বর্ণিত জাস্সাসা (গোয়েন্দা)। আবার কেউ বলেছেন, এটি হলো সেই সাপ যা পবিত্র কাবার দেওয়ালে ছিল। কুরাইশরা যখন কাবা ঘর নির্মাণ করার ইচ্ছা পোষণ করল তখন সাপটিই তাদের নির্মাণ কাজ শুরু করতে মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেল। একটি পাখি এসে সাপটিকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলে নির্মাণ কাজের বাধা দূর হয়ে যায়।
দাব্বাতুল আরদের কাজ : রাসুল (সা.) বলেন, ‘দাব্বাতুল আরদ বের হবে। তার সঙ্গে থাকবে মুসা (আ.) এর লাঠি এবং সুলায়মান (আ.) এর আংটি। ঈমানদারদের কপালে মুসা (আ.) এর লাঠি দিয়ে নুরানি দাগ টেনে দেবে। ফলে তাদের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। আর কাফেরদের নাকে সুলায়মান (আ.) এর আংটি দিয়ে দাগ লাগাবে। ফলে তাদের চেহারা অনুজ্জ্বল হয়ে পড়বে। তখন অবস্থা এমন হবে যে, কোনো খাবারের টেবিল ও দস্তরখানায় কয়েকজন মানুষ বসলে প্রত্যেকেই একে অপরের ঈমান ও কুফুরির বিষয়টি স্পষ্ট দেখতে পাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৭৯২৪)।
অন্য একটি হাদিসে এসেছে, হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘দাব্বাতুল আরদ বের হবে এবং মানুষের নাকে চিহ্ন দেবে। তারপরও মানুষ পৃথিবীতে জীবনযাপন করবে। প্রাণীটি সব মানুষের নাকেই দাগ লাগিয়ে দেবে। এমনকি উট ক্রয়কারীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তুমি এটি কার কাছ থেকে ক্রয় করেছ? সে বলবে, ‘আমি এটি নাকে দাগ লাগানো অমুক ব্যক্তির কাছ থেকে ক্রয় করেছি।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৩২২)।
সে পুরো পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করবে এবং সব মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘জন্তুটি মানুষের মতোই কথা বলবে।’ (পূর্বোক্ত উৎস)। হাদিসে এসেছে, সে মানুষকে তাকওয়া, তাওয়াক্কুল, আল্লাহর ভয় প্রভৃতি বিভিন্ন সদুপদেশ দিতে থাকবে।
দাব্বাতুল আরদ কখন বের হবে : ইবনু কাসির বলেন, ‘আখেরি জামানায় মানুষ যখন নানা পাপাচারে লিপ্ত হবে, মহান আল্লাহর আদেশ পালন বর্জন করবে এবং দ্বীনকে পরিবর্তন করবে তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের সামনে এই জন্তুটি বের করবেন।’ (তাফসিরে ইবনু কাসির-৩/৩৫১)।
ফাতহুল বারিতে বলা হয়েছে, কেয়ামতের বড় বড় কয়েকটি আলামত ঘটে যাওয়ার পর ১ বছর জিলহজ মাসের কোরবানির ঈদের দিবাগত রাত এত দীর্ঘ হতে থাকবে যে, সফররত ব্যক্তিরা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়বে, শিশু-বাচ্চারা ঘুমাতে ঘুমাতে ক্লান্ত হয়ে জেগে উঠবে, গবাদিপশুরা চারণভূমিতে বের হতে ছটফট শুরু করবে, লোকেরা ভয়ে ও আতঙ্কে চিৎকার করে কান্নাকাটি ও দোয়া-তওবা করতে থাকবে; এভাবে ৩-৪ দিন সময় পরিমাণ দীর্ঘ রাতের অবসান ঘটিয়ে চন্দ্রগ্রহণের মতো টিমটিমে আলো নিয়ে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হবে। এই নিদর্শন প্রকাশ পাওয়ার পর পৃথিবীর সব মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং তওবা করবে। কিন্তু তখন ঈমান ও তওবা আর কবুল করা হবে না। (ফাতহুল বারি : ১১/৩৫৩)।
আকাশে আলো ফোটার পর মানুষ যখন বাইরে বের হবে তখন দুপুরের দিকে কাবা গৃহের পূর্ব দিকে অবস্থিত সাফা পাহাড় ভূমিকম্পে ফেটে যাবে। তখন সেখানকার জমিনের ভেতর থেকে দাব্বাতুল আরদ বের হবে। (মুসলিম : ২৯৪১)।
পৃথিবীর কোন জায়গা থেকে প্রাণীটি বের হবে : ১. এটি বের হবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সম্মানিত মসজিদ থেকে। ইবনু’উমার (রা.) বলেন, সাফা পাহাড় ফেটে প্রাণীটি বের হবে। তিনি বলেন, ‘আমি যদি চাইতাম তাহলে যে স্থানটি থেকে বের হবে তাতে পা রেখে দেখাতে পারতাম।’ (তাফসিরে কুরতুবি-১৩/২৬৩, তাবারানী ফিল আওসাত-২/১৭৬)।
২. জন্তুটি তিনবার বের হবে। প্রথমে বের হবে কাবা ঘর থেকে দূরবর্তী একটি গ্রাম থেকে। অতঃপর কিছু দিন লুকিয়ে থাকার পর আবার বের হবে। পরিশেষে কাবা ঘর থেকে বের হবে। এ ব্যাপারে আরও কথা বর্ণিত আছে। সব মিলিয়ে আমরা বলব, মক্কা থেকে দাব্বাতুল আরদ বের হবে। অতঃপর সমগ্র পৃথিবীতে ভ্রমণ করবে।
দাব্বাতুল আরদের পরবর্তী অবস্থা : দাব্বাতুল আরদ তার কাজ শেষ হওয়ার পর অদৃশ্য হয়ে যাবে। এরপর আল্লাহ তায়ালা ইয়েমেনের দিক থেকে রেশমের মতো মোলায়েম একটি বাতাস প্রবাহিত করবেন। যার অন্তরে সামান্য পরিমাণও ঈমান থাকবে তার শরীরে এই বাতাস স্পর্শ করবে। ফলে সব ঈমানদার ব্যক্তির ইন্তেকাল হয়ে যাবে। তারপর পৃথিবীতে শুধু নিকৃষ্ট লোকেরা থাকবে। তাদের ওপর কেয়ামত কায়েম হবে। (মুসলিম : ১১৭, ১৯২৪)।
অন্য হাদিসে এসেছে, পৃথিবীতে তখন শুধু নিকৃষ্ট আর পাপাচারী লোকেরা থাকবে। তাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত সুখময় হবে। পাখির মতো ক্ষিপ্র থাকবে তাদের গতি। পশু-পাখির মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে। কোনো কল্যাণকর কাজ তারা করবে না। কেউ কোনো মন্দ কাজ করলে বারণ করবে না। তখন শয়তান তাদের সামনে মানুষের আকৃতিতে এসে বলবে আমি তোমাদের যা করতে বলব তোমরা কি তা করবে না? লোকেরা বলবে, তুমি আমাদেরকে কী করতে বল? তখন শয়তান তাদের মূর্তিপূজার আদেশ করবে। সে যুগে মানুষের প্রাচুর্য ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অনেক বৃদ্ধি পাবে। অতঃপর শিঙ্গায় ফুক দেওয়া হবে। (মুসলিম : ২৯৪০)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় ও দাব্বাতুল আরদের আবির্ভাবের পর পৃথিবী আরও ১২০ বছর অবশিষ্ট থাকবে। (ফাতহুল বারি : ৩৬১)।
এই নশ্বর জগৎ ধ্বংসের সময় সন্নিকটে। কেয়ামতের ছোট ছোট আলামত প্রকাশিত হয়েছে এবং তার অনেকগুলোই বর্তমানে আমরা প্রকট আকারে দেখতে পাচ্ছি। ছোট আলামতগুলো বড় আলামতের ইঙ্গিতবাহী। তাই আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। নেক আমলের প্রতি আগ্রহী হওয়া উচিত। বর্তমান যুগের নানাবিধ ফেতনা থেকে বেঁচে থাকার জন্য জানপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত। পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী, দেশবাসী সবাইকে নেক আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা উচিত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন।