ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আমাদের করণীয়

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আমাদের করণীয়

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় প্রাকৃতিক পরিবেশে যখন ব্যতিক্রম লক্ষ্য করি এবং তা আমাদের জীবন ও জীবিকার জন্য ক্ষতিকর মনে করি, তখন তাকে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলি। এই দুর্যোগ আমাদের হাতে অর্জিত বলে কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত আছে। এর প্রধানতম কারণ হলো, আমরা যখন নিজেরাই প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করি, তখন প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। অনেক সময় প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার বিষয়টি আমাদের হিসাব-নিকাশের মধ্যে আসে না। অথচ এর কারণে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। এই কারণগুলো নৈতিক, যা চোখে দেখা যায় না। যেমন জেনা, ব্যভিচার, অশ্লীলতা ও আল্লাহ রাসুলের নাফরমানি যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন আল্লাহ পাক আসমানি আজাব-গজব নাজিল করেন এবং তা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখা দেয়।

পবিত্র কোরআনে কারিমে এ ধরনের বিভিন্ন দুর্যোগ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। যেমন হজরত নুহ (আ.)-এর সময়ের মহাপ্লাবন, হজরত লুত (আ.)-এর সময়ের ভূমি ওলট-পালট করে দেওয়ার বর্ণনা। বস্তুত, আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন সময়ে দুর্যোগ দিয়ে মানুষকে হেদায়াতের পথে আসার আহ্বান জানান, মানুষকে সতর্ক করেন। মানুষ যেন আল্লাহকে ভুলে না যায় এ কথা মনে করিয়ে দেন।

যেদিন দুনিয়া ধ্বংস হবে বা কেয়ামত হবে, সেদিনও মহাদুর্যোগ কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় হবে, তার পুরোপুরি বর্ণনা আল্লাহতায়ালা আগাম বলে দিয়েছেন পবিত্র কোরআনে কারিমে। ঝড়-টর্নেডো ও ভূমিকম্প এসব কিছু সে তুলনায় অতি তুচ্ছ, এটা বলাবাহুল্য।

কেয়ামতের পূর্বাভাস বিষয়ে বলা হয়েছে হজরত ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গার ফুৎকারে পাহাড়-নদী, গাছপালা, বাড়িঘর সবই বাতাসে উড়বে। ধূলিময় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে সমগ্র পৃথিবী। মাঝেমধ্যে সংগঠিত দুর্যোগ আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই সত্যতার কথা। বস্তুত দুনিয়ার এমন সব দুর্যোগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের কোনো শক্তি ও ক্ষমতা নেই। অপার ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ, তিনিই আমাদের আশ্রয়। তাই শুধু দুর্যোগকালীন সময়ে নয়, সর্বদা তার আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে, সর্ব প্রকারের সাহায্য চাইতে হবে তারই কাছে। তার দেওয়া আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে। ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধাচারণকে ভয় করতে হবে।

দুর্যোগ শুধু পাপের কারণেই হয় এমনটি নয়, এটা মানুষের জন্য একটি পরীক্ষা। শেষ নবী হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে নানা দুর্যোগ দেখা দিয়েছিল। এসব দুর্যোগে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে সতর্ক থেকেছেন ও উম্মতকে আগাম সতর্ক করে গেছেন। যেমন তিনি সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় আহার গ্রহণ করতেন না। এ সময় তিনি সেজদায় নত হয়ে আল্লাহতায়ালার কাছে দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ চাইতেন। আশু বিপদ থেকে মুক্তি চেয়ে আশ্রয় কামনা করতেন।

দুর্যোগ প্রসঙ্গে বহু তথ্য-উপাত্ত দেওয়া আছে কোরআন-হাদিসে। জীব-জন্তু বিশেষ করে পাখি, ইঁদুর, সাপ এবং মাছ দুর্যোগের আগাম বার্তা পায়। হুদহুদ পাখি, উট পাখি, চাতক পাখি আগাম ঝড়-বৃষ্টির বার্তা পায়। তাদের আচরণে এসব বোঝাও যায়। পশু-পাখি ও জীব-জন্তুরা কিন্তু এই ক্ষমতা পেয়েছেন আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে।

মেঘের আচরণ বা তার আকার ও রং এবং তার গতিবিধি সম্পর্কেও বলা হয়েছে পবিত্র কোরআনে কারিমে। কালো মেঘ এবং লাল মেঘের বর্ণনা এবং তাতে ক্ষতির বিবরণও আমরা এসব বর্ণনা থেকে জানতে পারি।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও দুর্যোগ হয়। সেগুলো হয় সরাসরি মনুষ্যসৃষ্ট বা মানুষের কর্মকা-ের ফলে। যেমন দুর্বল ইমারত ধ্বসে যাওয়া, বৈদুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকা- গার্মেন্ট ভবনে আগুন লেগে যাওয়া এগুলো আমাদের অসতর্কতা, অবহেলা ও কৃতকর্মের ফল।

আমাদের দেশে হরহামেশা বিপর্যয় ও দুর্যোগ ঘটছে একেবারে অসাবধানতার কারণে। বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ অথবা তারের ত্রুটিজনিত কারণে বেশিরভাগ অগ্নিকা- ঘটছে। গ্রামাঞ্চলে অগ্নিকা- হয় চুলা অথবা বিড়ি-সিগারেটের আগুন থেকে। গার্মেন্টে আগুন লাগার পর হুড়োহুড়ি করে একইসঙ্গে বেরুনোর সময় পদদলিত হয়ে অথবা ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে বহু লোক মারা যায়।

বিভিন্ন সময় দুর্যোগ আসবে এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। কারণ, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই তা চলে আসছে। তাই বলে হতাশ হয়ে বসে থাকলে চলবে না। দুর্যোগের সময় মনে সাহস রাখতে হবে। সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে আক্রান্তদের জন্য। কারও বিপদে তার পাশে দাঁড়ানো সওয়াবের কাজ। এটা ঈমানি দায়িত্বও বটে। দুর্যোগকালীন সময় কোনো মোমিন হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না।

এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হলে যেসব প্রস্তুতি থাকা দরকার, ওই সব কৌশল আমাদের শিখতে হবে, জানতে হবে। বিশেষ করে আমাদের সন্তানদের শেখাতে হবে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষমতা হয়তো আমাদের আয়ত্বে নেই। কিন্তু সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে যেসব বাধা অতিক্রম করা যায়, তা আমরা বিভিন্ন সময় প্রমাণ করেছি। বস্তুত দুর্যোগ মোকাবিলায় দরকার সাহস, ধৈর্য এবং সম্মিলিত শক্তি। বাংলাদেশের জনগণ যে কোনো বিপর্যয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে অন্য মানুষের সাহায্যে এগিয়ে যায়, এটি আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে লালিত ইসলামি শিক্ষার সুফল। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বেলায় দেখা যায়, কোনো জলোচ্ছ্বাস বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও নারী নির্যাতনের তা-ব শুরু হয়। অথচ আমাদের গরিব দেশের মানুষ অসহায় দুর্গত মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের দেশের এই সম্পদের তুলনা হয় না

(আলোকিত ডেস্ক)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত