
মহান রবের নৈকট্য অর্জনের মাধ্যমে প্রিয় বান্দা হওয়ার শ্রেষ্ঠতম পথ হলো হজ, যা একজন মোমিনের শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত এবং মুসলিম উম্মাহর ভাতৃত্ববোধ ও পারস্পরিক সম্প্রীতি অর্জনের বিশ্ব সম্মেলন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। ইসলামি শরিয়ার বিধান অনুযায়ী, আরবি জিলহজ মাসের ৮-১২ তারিখ পর্যন্ত ৫ দিন পবিত্র মক্কা নগরীর প্রান্তরে আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা, মিনার প্রান্তরে কংকর নিক্ষেপ করা, মুজদালিফায় রাত যাপন করা, সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার প্রদক্ষিণ করা, ইহরাম বাঁধা এবং বায়তুল্লাহ তাওয়াফ তথা তিনটি ফরজ বিধান, পাঁচটি ওয়াজিব ও সুনির্দিষ্ট কিছু সুন্নত আদায়ের নির্ধারিত কর্মপ্রক্রিয়াকে হজ বলে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ এবং আর্থিকভাবে হজের ব্যয়ভার ও পরিবারের মৌলিক প্রয়োজনীয় খরচ বহন করতে সক্ষম প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য জীবনে কমপক্ষে একবার হজ করা আবশ্যক। আর সেজন্য প্রয়োজন হজ করার একনিষ্ঠ নিয়ত ও প্রচেষ্টা এবং হজে রওনা হওয়ার আগে হজের করণীয় ও বর্জনীয়তা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের ওপর আল্লাহর অধিকার এই যে, বায়তুল্লাহ (পবিত্র কাবা) পর্যন্ত পৌঁছানোর শক্তি ও সামর্থ্য যে রাখে, সে যেন হজ করে। আর এই নির্দেশ যে অমান্য করে কুফরি আচরণ করবে (অর্থাৎ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে) তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্ব প্রকৃতির কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না।’ (আলে-ইমরান : ৯৭)।
প্রকৃত মোমিন কখনও নিজেকে হজ করা থেকে বিরত রাখতে পারে না। কেননা তার মৌলিক বিশ্বাস থাকে, মহান রবের দেওয়া শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা এবং তাঁরই দেওয়া সৃষ্টিগত উপাদান ব্যবহার করে উপার্জিত অর্থ আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করার নামই তাকওয়া তথা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যশীল বিশ্বাস। যে আনুগত্যশীল বিশ্বাস তাকে সত্যের পথে পারিচালিত হতে অনুপ্রাণিত করে। পবিত্র হজের সময় শারীরিক কষ্টসাধ্য বিধিনিষেধ পালন করা ও মানুষের স্বভাবজাত অত্যন্ত প্রিয় মোহ অর্থ ব্যয়ের মাধ্যেম ব্যক্তির বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অহঙ্কার, প্রতিহিংসা, কৃপণতা বিদূরিত হয়ে ব্যক্তির মাঝে সৃষ্টি হয় নম্রতা, পরোপকারিতা ও বিনয়ী মনোভাবের স্বভাব, যার কর্মধারাবাহিকতা থেকে অর্জিত হয় আত্মিক পরিশুদ্ধতা। প্রকৃতপক্ষে শারীরিক কষ্ট ও আর্থিক ব্যয়ের মাধ্যমে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে মহান রবের কাছে সোপর্দ করার নামই হলো হজ, যা মানুষকে ইসলামি বিধান পালনে এবং সামাজিক জীবন ব্যবস্থায় শালীনতার উৎকৃষ্ট শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে সাহায্য করে। কেননা, হজের সময় ইহরাম বাঁধা অবস্থায় কুরুচিপূর্ণ বা অপ্রয়োজনীয় কথা বলা অথবা মানুষের কষ্ট হয় এমন কোনো কাজ করা সম্পূর্ণরূপে হারাম, যা ব্যক্তিকে সব পাপাচার ও গোনাহ থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে আত্মসংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করে এবং অশ্লীল ও গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে সে হজ থেকে এমনভাবে ফিরে আসে যেন আজই মায়ের গর্ভ থেকে সে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। অর্থাৎ জন্মের পর শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে সেও তেমনি নিষ্পাপ হয়ে যায়।’ (বোখারি-১৪২৮)।
হজ ব্যক্তিকে আত্মরক্ষায় বলীয়ান হওয়ার পাশাপাশি অভাব ও দরিদ্রতা দূর করে সমৃদ্ধি অর্জনের পথকে সুগম করে দিয়ে ইহলৌকিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির সৌভাগ্যের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা বারবার হজ ও ওমরাহ করতে থাকো। এর ফলে আল্লাহ তোমাদের দরিদ্রতাকে দূর করে দেবেন এবং তোমাদের গোনাহগুলোকে ক্ষমা করে দেবেন। এখানে হজ ও জাকাতের মতো বিধান থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়, ইসলাম দরিদ্রতাকে নিরুৎসাহিত করে আর্থিক সচ্ছলতাকে উৎসাহিত করে জীবনযাপনে সহজতার প্রতি দৃষ্টিক্ষেপণ করে। কেননা, হজ ও জাকাত আর্থিক ইবাদত যা আর্থিক সচ্ছলতা ছাড়া করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি অর্থ উপার্জনের সঠিক সুস্পষ্ট পথনির্দেশনাও দিয়েছে ইসলাম। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় দরিদ্রতা বা অভাবগ্রস্ত অবস্থায় বসবাস করাকে অনেক মোমিন ইসলামের যাপিত ব্যবস্থার অংশ মনে করেন, যা বাস্তবিক ধর্ম ইসলামের চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত।
পরিবারের মায়া ত্যাগ করে, নিজ উপার্জিত অর্থ খরচ করে, বহু কষ্ট ও সমস্যার সম্মুখীন হয়ে ধৈর্য ধারনের মাধ্যমে হজের বিধান পালনের ফলে আত্মনিয়ন্ত্রণের মানবীয় গুণাবলি সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সব পরিস্থিতি নিজের ক্রোধ ও লোভ নিয়ন্ত্রণ রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে অবিচল থাকার চেতনাই হলো হজের বিশেষ শিক্ষা। আবার হজের সফরে গণজমায়েত ও বারবার স্থান পরিবর্তনের কারণে শারীরিক পরিশ্রমের কষ্ট ও নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে, তখন সেই মুহূর্তে দেখা যায় মানবীয় স্বভাবের কারণে সেখানে মনোমালিন্যতা বা ক্রোধ জন্ম নেয়। আর এ জন্যই কোরআন মাজিদে, হজের সময় আত্মনিয়ন্ত্রণের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যা আত্মশুদ্ধির বিশেষ প্রশিক্ষণ। একটা বিষয় লক্ষণীয়, নামাজ পড়া ও রোজা রাখা কঠিন কাজ, তার চেয়ে কঠিন কাজ আল্লাহর পথে খরচ করা বা দান করা, আর তার চেয়েও কঠিন কাজ হলো রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখা, যা হজের সময় পরিপূর্ণভাবে অনুশীলনের সুযোগ হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট মাসগুলোতে হজের নিয়ত করবে, তাকে এ দিক দিয়ে সতর্ক থাকতে হবে যে, হজকালীন তার দ্বারা যেন কোনো পাশবিক লালসা তৃপ্তির কাজ, কোনো জেনা-ব্যভিচার, কোনো রকম লড়াই-ঝগড়ার কথাবার্তা অনুষ্ঠিত না হয়। আর তোমরা যা কিছু সৎকাজ করো আল্লাহ তা জানেন। আর তোমরা উত্তম পাথেয় সঙ্গে নিয়ে নাও। নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে আল্লাহর ভয়। হে বুদ্ধিমান লোকেরা, তোমরা শুধু আল্লাহকেই ভয় করো।’ (সুরা বাকারা-১৯৭)।
হজের সময় ইহরামের কাপড় পরিধানের মাঝে রয়েছে বিশেষ আত্মশুদ্ধির শিক্ষা। ইহরামের সাদা কাপড় পরিধানের মাধ্যমে মোমিন তার প্রভুর সামনে নিজের অস্তিত্ব বিলিয়ে দিয়ে এমনভাবে তার আনুগত্য প্রকাশ করে যেমন একটি মৃত লাশে সাদা কাফন পরানোর পরে অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়। মৃত লাশের যেমন বিশেষ কোনো পরিচয় থাকে না, তেমনি ইহরাম বাঁধার পর মানুষেরও আর কোনো বিশেষ পরিচয় থাকে না। তখন ভেতরের সব আমিত্বকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মানুষ হয়ে উঠি পরিশুদ্ধতার ছায়ায় পরিপূর্ণ। যদিও মানুষ বাইরের পোশাক যত সহজে পরিবর্তন করতে পারে ভেতরের পোশাক তত সহজে পরিবর্তন করা যায় না। আর সেই জন্যই হজ শারীরিক পরিশ্রমের কষ্ট সহ্য করিয়ে, নিজ উপার্জিত অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে মানুষের ভেতরে লুকায়িত মন্দ গুণের পোশাককে পরিষ্কার করে ধৈর্য, আত্মশুদ্ধি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের পথ দেখায়। আত্মশুদ্ধির পোশাক পরিধানের ফলে ব্যক্তিজীবনে সব কর্মে আল্লাহর স্মরণ প্রতিফলিত হয়। যার সুবাদে সমাজ ও পারিবারিক জীবনে নেমে আসে প্রশান্তির ছায়া এবং ব্যক্তিজীবন হয় পরিতৃপ্তময়। সন্তান যেমন তার মায়ের কোলে পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমায় মোমিনের জীবনও তখন হয়ে ওঠে তেমনই আনন্দদায়ক। অনন্তকাল যেন আমরা প্রিয় রবের সান্নিধ্যে থাকতে পারি সে জন্য আল্লাহ আমাদের হজের মতো একটি আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জনের বিধান দিয়েছেন। তবে সে হজ হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রাসুলের দেখানো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে। তখন মানুষ হজ থেকে নৈতিক ও আত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করে সব পাপ থেকে মুক্ত হয়ে নিষ্পাপ বান্দা হিসেবে নিজের ভেতরের মানবতাবোধ জাগ্রত করে, উন্নত চরিত্রের আলোয় আলোকিত হয়ে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে আত্মনিয়োজিত হতে পারবে। হজে দীর্ঘ সময় একজন মোমিন গোনাহ থেকে বিরত থাকার ফলে ও নিজের পাপগুলোর অধিক স্মরণে তার হৃদয় হয়ে উঠে কোমল ও আল্লাহর রহমতে পরিপূর্ণ। মোমিনের গোনাহ মাফ, পরকালীন মুক্তি, ইহজাগতিক সুশৃঙ্খল জীবনযাপন ও মহান রবের নৈকট্য লাভের জন্য একটি কবুল হজেই যথেষ্ট। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজে মাবরুর (কবুল হজ) এর বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (তিরমিজি-৯৩৩)। তাই মহান রবের কাছে আকুল আরজি জানাচ্ছি, তিনি যেন আমাদের সবাইকে একটি কবুল হজ করার খোশনসিব দান করে তাঁর গভীর তাৎপর্য ও উপলব্ধির জ্ঞান দান করেন। আমিন।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়