ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আবু লাহাব ও তার স্ত্রীর ধ্বংসের কাহিনি এবং কোরআনের মোজেজা

আবু লাহাব ও তার স্ত্রীর ধ্বংসের কাহিনি এবং কোরআনের মোজেজা

আবু লাহাব ছিল খুব হ্যান্ডসাম। শৌর্য-বীর্যে, বিত্ত-বৈভবে আরবের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি। তার স্ত্রী আরওয়া ছিল তৎকালীন সময়ের ফাস্ট লেডি, অসম্ভব রূপবতী; যার ফলে তাকে ডাকা হতো ‘উম্মে জামিল’ বা রূপবতী সুন্দরী নামে। মক্কার এই কাপলটি ছিল ‘সেলিব্রিটি’। একে তো দু’জনই সুদর্শন-সুন্দরী, দু’জনই মক্কার এলিট বংশের। আবু লাহাব হিশাম গোত্রের, আরওয়া উমাইয়্যার নাতনি, আবু সুফিয়ানের বোন। আবু লাহাব মক্কার সেরা ধনকুবেরদের একজন।

আল্লাহ রাসুলুল্লাহকে (সা.) নিজ গোত্রের মধ্যে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দিলেন। একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) সাফা পাহাড়ে উঠে ডাক দিলেন ইয়া সাবা’হাহ, ইয়া সাবা’হাহ। এ ধরনের বাক্য দ্বারা বিপদের ওয়ার্নিং দেওয়া হয়। আমরা যেমন বলি- অঃঃবহঃরড়হ ঢ়ষবধংব... বা একটি জরুরি ঘোষণা।

রাসুলুল্লাহর (সা.) আহ্বানে অনেকেই সাড়া দিয়ে জড়ো হলো। মানুষ তাঁকে কতটা বিশ্বাস করে, সেটা জানার জন্য তিনি একটি সিনারিও দাঁড় করালেন। ‘আচ্ছা, আমি যদি বলি একটা শত্রু বাহিনী তোমাদের ওপর আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে (পাহাড়ের অন্য পাশ দিয়ে, যা তোমরা দেখতে পাচ্ছ না)। সকাল অথবা সন্ধ্যা যে কোনো সময় তোমাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে?’ সবাই সমস্বরে বলল, ‘অবশ্যই আমরা তোমার কথা বিশ্বাস করব।’ তার মানে সবার কাছ থেকে বিশ্বস্ততার স্বীকৃতি পাওয়া গেল।

এবার রাসুলুল্লাহ (সা.) আসল কথায় এলেন, যা বলার জন্য সবাইকে জড়ো করেছেন। ‘আমি আল্লাহর এক ভীষণ আজাব সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করছি!’ একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আবু লাহাব বলে উঠল ‘তাব্বান লাকা আলে হাজা জামা’তানা ধ্বংস হও তুমি! এ জন্যই কি আমাদেরকে এখানে ডেকেছ?’

আবু লাহাব ছিল রাসুলুল্লাহর (সা.) আপন চাচা। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামের দাওয়াত প্রচার শুরু করলে এই প্রথমবারের মতো কেউ রাসুলের বিরোধিতা করল। শুধু বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হলো না, রাসুলকে অভিশাপ দিল এবং পাথর ছুড়ে মারতে উদ্যত হলো। আবু লাহাবের এমন উদ্ধত স্বভাব আল্লাহ পছন্দ করলেন না। তিনি একটি সুরা নাজিল করে অভিশাপের জবাব দেন। আল্লাহ বলেন, ‘তাব্বাত ইয়াদা আবি লাহাবি’উ ওয়াতাব ধ্বংস হোক আবু লাহাবের হস্তদ্বয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও।’ (সুরা লাহাব : ১)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতে গেলে আবু লাহাব পিছু পিছু গিয়ে মানুষকে কানপড়া দিত। সে বলত আমার ভাতিজা মিথ্যাবাদী, তোমরা তার কথা শুনো না। নবুয়তের আগে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার দুই মেয়েকে আবু লাহাবের দুই ছেলে উতবা ও মুয়াত্তাবের সঙ্গে বিয়ের আকদ দেন। বউ হিসেবে তাদের ঘরে তখনও তুলে দেননি। তবে নবীজি (সা.) ইসলাম প্রচার শুরু করার পর আবু লাহাব তার দুই ছেলেকে বাধ্য করে রাসুলের (সা.) মেয়েদেরকে তালাক দিতে। অবশ্য মক্কা বিজয়ের পর তার এই দুই ছেলে ইসলাম গ্রহণ করে।

রাসুলের (সা.) ছেলে কাসিমের ইন্তেকালের পর তাঁর দ্বিতীয় ছেলে আবদুল্লাহও ইন্তেকাল করেন। এতে আবু লাহাব শোকাহত না হয়ে বরং অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলে, ‘আজ মুহাম্মদের (সা.) নামনিশানা মুছে গেছে! সে নির্বংশ হয়ে গেল।’ তখন আল্লাহ পাক সুরা কাউসার নাজিল করে তার প্রতিবাদ করে রাসুল (সা.) কে সান্ত¡না দিয়ে বলেন, ওহে নবী! নিশ্চয় আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি। অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়–ন এবং কোরবানি করুন। যে আপনার শত্রু, সেই তো লেজকাটা, নির্বংশ।’ (সুরা কাউসার : ১-৩)।

নবুয়তের সপ্তম বছর বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত খাদিজাতুল কোবরা ও চাচা আবু তালিবসহ বনু হাশিম ও বনু আবদুল মুত্তালিব খান্দানের নারী-শিশুসহ ৫৩ জন সদস্য নিয়ে ৩ বছর শিয়াবে আবু তালিবে বন্দি ছিলেন। খাদ্য সংকট দেখা দেয়, অনাহারে দিন কাটান। আবু লাহাব মক্কায় আসা বণিকদেরকে বলত খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে, যাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তার পরিবার খেতে না পারেন। জীবন বাঁচাতে এ ৩ বছরে নবী পরিবারের লোকজন পশুর শুকনো চামড়া, গাছের পাতা ও গাছের ছাল খেতে বাধ্য হন। ফলে হজরত খাদিজাতুল কোবরা ও চাচা আবু তালিব দু’জনই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিন বছর পর অবরোধ উঠিয়ে নিলে চাচা আবু তালিব ও হজরত খাদিজাতুল কোবরা দু’জনই ৩ দিনের মাথায় ইন্তেকাল করেন।

আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আবদুল উযযা। এই সুরায় তাকে ‘আবু লাহাব’ ডাকার কারণ তার গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল সাদা-লালে মেশানো; সূর্য উদয়ের সময় যে রং থাকে। তার শিরকি নাম উচ্চারণ না করে আল্লাহ তার ডাক নামটি উল্লেখ করে তার পরিণতির কথাও যেন বলে দিচ্ছেন। তার নামের মতো আগুনের লেলিহান শিখায় হবে তার স্থান। সে একে তো ধনী ছিল, তদুপরি সে তার সন্তানদেরকে নিয়ে গর্ব করত। আল্লাহ পরের আয়াতে বলেন ‘তার ধন-সম্পদ ও উপার্জন তার কোনো উপকারে আসেনি’ বলে মন্তব্য করেন।

বদর যুদ্ধের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে আবু লাহাব অসহায়ভাবে মারা যায়। কীভাবে মারা যায়? তার শরীরে ফুসকুড়ি হয়, যা দেখতে অনেকটা প্লেগ রোগ ও গুটি বসন্তের মতো। এখন যেমন করোনার ভয়ে আমরা রোগীর কাছ থেকে দূরে থাকি, তখনও লোকজন রোগ সংক্রমণের ভয়ে আবু লাহাবের কাছ থেকে দূরে থাকত। মরার পর ৩ দিন ধরে কেউ তার লাশ টাচ করতে সাহস পাচ্ছিল না। লাশ পচে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। লোকজন তার ছেলেকে ধিক্কার জানায়। শেষমেশ ছেলেরা মজুরির বিনিময়ে কয়েকজন হাবশীকে দিয়ে লাশটি লম্বা লাঠি দিয়ে ঠেলে ঠেলে একটা গর্তে পুঁতে ফেলে। তারপর লাশটি মাঠিচাপা দেয়।

উম্মুল মোমেনিন হজরত আয়েশা (রা.) আবু লাহাবের দুর্গন্ধযুক্ত পুঁতে ফেলা লাশের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে তিনি নাক ঢেকে ওই স্থান অতিক্রম করতেন। (সিরাতে মুস্তফা, ইদরিস কান্দোলভী, কোরআনের প্রতিষ্ঠিত মোজেজা)।

আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জমিল শক্ত রশি দিয়ে তার লাকড়ির আঁটি বাঁধত। একদিন সে এভাবে বাঁধা একটি লাকড়ির আঁটি মাথায় নিয়ে একটি পাথরের ওপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় একজন ফেরেশতা সেখানে উপস্থিত হয়ে তার লাকড়ির আঁটিটি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ফলে তার গলায় ফাঁস লেগে যায় এবং সে অবস্থায়ই সে মারা যায়। আল্লাহ আবু লাহাবের মাধ্যমে দেখিয়ে দিলেন যারা রাসুলের (সা.) বিরোধিতা করে দুনিয়ায় তাদের কী পরিণতি হয়। আখেরাতের পরিণতি তো এখনও বাকি।

আবু লাহাবের স্ত্রী আরওয়া রাসুলকে (সা.) কষ্ট দেওয়ার বেলায় ছিল একধাপ এগিয়ে। কোরআনে তাকে উল্লেখ করা হয়েছে কাঠ বহনকারী, নেকলেসধারী, গোনাহর বোঝা বহনকারী। সে রাসুলের (সা.) নাম ব্যঙ্গ করে বলত মুযাম্মাম বা নিন্দিত। সে রাতে রাসুলের (সা.) ঘরের সামনে কাঁটা বিছিয়ে রাখত, যাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বের হওয়ার সময় ব্যথা পান। শারীরিক এবং মানসিক, দু’ভাবেই সে রাসুলকে (সা.) কষ্ট দিত। স্বামীর পাশাপাশি কোরআনে উম্মে জামিল আরওয়াকেও বলা হয়েছে তার স্থান হবে জাহান্নামের লেলিহান আগুনে। কোনো কোনো তাফসিরে আছে সে বরং জাহান্নামে লাকড়ি বহন করে তার স্বামীর ওপর নিক্ষেপ করবে, যাতে আগুন আরও প্রজ্বলিত হয়। দুনিয়াতে সে যেমন স্বামীকে সাহায্য করত, জাহান্নামেও সে স্বামীকে আগুনে পুড়তে সাহায্য করবে।

‘সুরা লাহাব’ হলো দুনিয়ার কাফেরদের জন্য একটা সতর্কবার্তা। যারা রাসুলের (সা.) বিরুদ্ধাচারণ করবে, যারা ইসলামের ক্ষতি করতে চাইবে, তাদের আখেরাতে কী পরিণতি হবে এবং দুনিয়ায় কী ক্ষতি হবে সেটার উদাহরণ হলো আবু লাহাব ও তার স্ত্রী। যারা ডলার, পাউন্ড, টাকা ব্যয় করছে ইসলামের নাম-নিশানা পৃথিবী থেকে মুছে ফেলার জন্য, একদিন তাদের নাম-নিশানা মুছে যাবে, ইসলামের পতাকা ঠিকই পতপত করে উড়বে।

লেখক : উপাধ্যক্ষ, দারুল উলুম কামিল

মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত