
আরবি শব্দ ‘মহররম’ এর আভিধানিক অর্থ হলো মর্যাদাপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ ইত্যাদি। যেহেতু অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রহস্যময় তাৎপর্য নিহিত আছে এ মাসকে ঘিরে, তার সঙ্গে এ মাসে সুপ্রাচীনকাল থেকেই যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল, এসব কারণেই এ মাসটি ফজিলতপূর্ণ। অন্যদিকে মহান আল্লাহ তায়ালা হিজরি সনের যে চারটি মাসকে সম্মানিত করেছেন তা হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও সফর। সম্মানিত এ চারটি মাসের মধ্যে মহররম অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ও বরকতময় মাস; যে মাসকে আইয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগের আরব্য বেদুইনরাও বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখত। আবার হিজরি সনের প্রথম মাসও মহররম। হাদিস শরিফে চান্দ্রবর্ষের বারো মাসের মধ্যে মহররমকে ‘শাহ্রুল হারাম’ বা ‘শাহ্রুল্লাহ্’ (আল্লাহ্র মাস) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয় এ মাসকে ঘিরে। শুধু উম্মতে মুহাম্মদিই নয় বরং পূর্ববর্তী অনেক উম্মত ও নবির অবিস্মরণীয় ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল এই মাসে।
ইসলামি পঞ্জিকা অনুযায়ী মহররমের দশম দিনকে আশুরা বলা হয়। আরবি শব্দ ‘আশারা’ অর্থ দশ আর ‘আশুরা’ অর্থ দশ বা দশম। শাব্দিক অর্থে যে কোনো মাসের ১০ তারিখকেই আশুরা বলা যায়। কিন্তু ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় শুধু মহররম মাসের ১০ তারিখকেই আশুরা নামে অভিহিত করা হয়। কারও কারও মতে, এ মাসের ১০ তারিখে ১০টি তাৎপর্যবহ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বিধায় এ দিনকে আশুরা নামে সম্বোধন করা হয়। মুসলিম উম্মাহর জন্য এটি একটি তাৎপর্যময় ও গুরুত্ববহ দিন। মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতি বছর পবিত্র আশুরা পালিত হয়। ৬৮০ খ্রি. মোতাবেক ৬১ হিজরির এই দিনে অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) চক্রান্তকারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে মর্মান্তিকভাবে শাহাদতবরণ করেন। বিশ্বের মুসলমানদের কাছে দিনটি একদিকে যেমন শোকের, তেমনি হত্যা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার চেতনায় উজ্জ্বল। ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তার আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ত্যাগের মহিমা মুসলিম উম্মাহর এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। জুলুম-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং অসত্য ও অন্যায় প্রতিরোধে ইমাম হুসাইন (রা.) এর এ ভূমিকায় মানবজীবনের জন্য বিরাট একটি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
ইসলামের ইতিহাসে কারবালার এই শোকাবহ ঘটনার আগেও এ দিনে নানা তাৎপর্যময় ঘটনা ঘটেছে। পাষ- ইয়াজিদ বাহিনীর সৈন্যদের হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পরিবার-পরিজন, সঙ্গী-সাথিসহ হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এর শাহাদতবরণের এ মর্মান্তিক ঘটনা ছাড়াও এই দিনে পৃথিবীতে অনেক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে বলে হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে। বর্ণিত আছে, ১. আল্লাহ তায়ালা আকাশ জমিন পাহাড় পর্বতসহ পুরো পৃথিবী এ দিনে সৃষ্টি করেন। ২. আদি মানব হজরত আদম (আ.) এই দিনে পৃথিবীতে আগমন করেন, এই দিনই তার তওবা কবুল করা হয় এবং এ দিনে তিনি স্ত্রী হাওয়া (আ.) এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে সাক্ষাৎ লাভ করেন। ৩. হজরত ইউনুছ (আ.) এই দিনে ৪০ দিন পর মাছের পেট থেকে আল্লাহর রহমতে মুক্তি লাভ করেন। ৪. এই দিনই হজরত নুহ (আ.) এর নৌকা মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পেয়ে তুরস্কের জুদি নামক পর্বতে নোঙর করে। ৫. হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকু-ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর সেখান থেকে ১০ মহররম মুক্তি লাভ করেন। ৬. দীর্ঘ ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগের পর হজরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করেন। ৭. হজরত ইয়াকুব (আ.) এর পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.) তার ১১ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে কূপে পতিত হন এবং পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ ৪০ বছর পর ১০ মহররম তারিখে পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ করেন। ৮. হজরত মুসা (আ.) এই দিনে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেন এবং অভিশপ্ত ফেরাউনকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। ৯. এই দিনে হজরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং তার জাতির লোকেরা তাকে হত্যা চেষ্টা করলে আল্লাহ পাক তাকে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে মুক্তি দান করেন। ১০. কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রা.) পরিবার-পরিজনসহ শাহাদতবরণ। এছাড়া হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে, মহররম মাসের ১০ তারিখ আশুরার দিনেই কেয়ামত সংঘটিত হবে।
ইসলামের ইতিহাসে ১০ মহররম তারিখটির নানা গুরুত্ব ও তাৎপর্য থাকলেও কারবালায় ঘটে যাওয়া সর্বশেষ মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণেই বর্তমান দুনিয়ার মুসলমানর দিনটি পালন করে থাকেন। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, হজরত মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াজিদ অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেন এবং এ জন্য ষড়যন্ত্র ও শক্তি ব্যবহারের পথ বেছে নেন। চক্রান্তের অংশ হিসেবে মহানবি হজরত মুহাম্মদ (স.) এর আরেক দৌহিত্র হজরত ইমাম হাসান (রা.) কে বিষপান করিয়ে হত্যা করা হয়। একই চক্রান্ত ও নিষ্ঠুরতার ধারাবাহিকতায় ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পরিবার-পরিজন ও ৭২ জন সঙ্গীসহ শাহাদতবরণ করেন হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)। তাদের হত্যার ক্ষেত্রে যে নির্মম-নিষ্ঠুর পথ বেছে নেওয়া হয়েছে, ইতিহাসে এর নজির বিরল। অসহায় নারী ও শিশুদের পানি পর্যন্ত পান করতে দেয়নি ইয়াজিদ বাহিনী। বিষাক্ত তীরের আঘাতে নিজের কোলে থাকা শিশুপুত্র আলী আসগরের মৃত্যুর পর আহতবস্থায় অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে শহীদ হন হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)। আশুরার এই ঐতিহাসিক ঘটনার মূল চেতনা হচ্ছে ক্ষমতার লোভ, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য চক্রান্ত ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এর উদ্দেশ্য ও আদর্শ বাস্তব জীবনে অনুসরণ করাই হবে এ ঘটনার সঠিক মর্ম অনুধাবনের বহিঃপ্রকাশ। অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান ও ত্যাগের যে শিক্ষা কারবালা মানবজাতিকে দিয়েছে, তা আজকের দুনিয়ার অন্যায় ও অবিচার দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
আশুরার দিনে অনেক আম্বিয়ায়ে কেরাম আল্লাহপাকের সাহায্য লাভ করেন এবং কঠিন বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি লাভ করেন। এই সাহায্যের শুকরিয়া হিসেবে নবি-রাসুলরা এবং তাদের উম্মতরা এ দিনে রোজা পালন করতেন। যেহেতু আশুরার দিনটি অত্যন্ত পবিত্র ও তাৎপর্যময় দিন। তাই এ দিনে উম্মতে মুহাম্মদি হিসেবে বিশেষ নেক আমল করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। মহররম মাসে তথা মহররমের ১০ তারিখে (পবিত্র আশুরার দিন) রোজা রাখা সম্পর্কে অনেক বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, আশুরার দিনে আগের নবঅ (আ.)রা রোজা পালন করতেন, সুতরাং তোমরাও এদিনে রোজা পালন করো। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ্ (সা.) আশুরা ও রমজানের রোজা সম্পর্কে যেরূপ গুরুত্ব প্রদান করতেন, অন্য কোনো রোজা সম্পর্কে সেরূপ গুরুত্বারোপ করতেন না। (বোখারি ১/২১৮)। অন্য এক হাদিসে নবী (সা.) বলেছেন, আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ্ তায়ালা এ উসিলায় অতীতের এক বছরের গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (মুসনাদে আহমদ ও তিরমিজি শরিফ)।
হজরত আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এই রোজা বিগত বছরের গোনাহ মুছে দেয় (মুসলিম : ১১৬২)। রাসুলুল্লাহ্ (সা.) আরও বলেন, রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের আশুরার রোজা। (সুনানে কুবরা : ৪২১০, মিশকাত শরিফ)। হজরত আবু মুসা আশয়ারি (রা.) বর্ণনা করেন, আশুরার দিন ইহুদিরা ঈদ পালন করত। রাসুল (সা.) সাহাবিদের সেদিন রোজা রাখতে নির্দেশ দিলেন। (বোখারি : ২০০৫, মুসলিম : ১১৩১)।
হজরত যাবের (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ্ (সা.) আমাদের আশুরার দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়ে নিয়মিত তিনি আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না এবং নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরাখবরও নিতেন না। (মুসলিম শরিফ : ১১২৮)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে আপন পরিবার-পরিজনের মধ্যে পর্যাপ্ত খানাপিনার ব্যবস্থা করবে, আল্লাহ তায়ালা পুরো বছর তার রিজিকে বরকত দান করবেন। (তিবরানি শরিফ : ৯৩০৩)। হজরত হাফসা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) চারটি কাজ কখনও ছেড়ে দিতেন না। তার মধ্যে একটি আশুরার রোজা। (সুনানে নাসায়ি)।
মোদ্দাকথা, মহররমের শিক্ষা হলো অন্যায়-দুরাচারের বিরুদ্ধে আদর্শিক সংগ্রাম পরিচালনা করার শিক্ষা। জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের অকুতোভয় লড়াইয়ের সাহস সঞ্চার করার শিক্ষা। তাই বিশ্ব মুসলিমের কাছে উদাত্ত আহ্বান, আসুন এই পবিত্রতম দিনে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সচেষ্ট হই এবং ইমাম হুসাইন (রা.) এর আদর্শকে বুকে ধারণ করে অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে আওয়াজ বুলন্দ করি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর