উত্তম চরিত্র মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ। সৎচরিত্রের কারণে যেমন মানুষের সম্মান, মর্যাদা বৃদ্ধি পায় তেমনি অসৎ চরিত্রের কারণে মানুষের সম্মান-মর্যাদা, যশ-খ্যাতি কমে যায়। শুধু কি তাই? সৎচরিত্রের কারণে মানুষ মরে গিয়েও হাজার বছর ধরে মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকে। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম তাঁরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর অসৎ চরিত্রের মানুষ হাজার বছর দুনিয়াতে বেঁচে থেকেও যেন মানুষের অন্তরে মরে যায়। অর্থাৎ অসৎ চরিত্রের মানুষকে সবাই মুখে মুখে ভালোবাসলেও অন্তরে সবাই তাকে ঘৃণা করে। তাই উত্তম চরিত্র অর্জনে মহান আল্লাহ তায়ালা রাসুল (সা.) কে অনুসরণ করতে বলেছেন। কেননা উত্তম চরিত্রের যতগুলো গুণ রয়েছে সব গুণের সমাবেশ ঘটেছিল রাসুল (সা.) এর জীবনে। এ জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য রয়েছে রাসুল (সা.) এর মধ্যে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব : ২১)।
ইসলামি চরিত্রে বিভূষিত হওয়া এবং শয়তানি চরিত্র থেকে বিরত থাকার নামই হুসনুল খুলক তথা উত্তম চরিত্র। তাই আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এমন হওয়া উচিত যে, আমরা মন্দকে দূরীভূত করব ভালো দ্বারা আর নিকৃষ্টকে প্রতিহত করব উৎকৃষ্ট আচরণ দ্বারা। অর্থাৎ, কেউ অন্যায় করলে বদলা নেব ন্যায় প্রতিষ্ঠা দ্বারা, জুলুম করলে বদলা নেব তাকে ক্ষমার দ্বারা এবং কেউ মূর্খতা বা অশ্লীল কথা বললে তার উত্তর দেব নীরবে সহ্য করার দ্বারা। অসৎচরিত্রের বিরুদ্ধে এমন সুন্দর ক্ষমাসুলভ আচরণ করলে এর ফল এই হবে যে, চিরশত্রু হয়ে যাবে বন্ধু আর যে দূরে দূরে থাকত সে হয়ে যাবে নিকটবর্তী এবং রক্ত-পিপাসু দুশমন হয়ে যাবে প্রেম-পিপাসু অন্তরঙ্গ বন্ধু। যেমন আল্লাহ তায়ালা কোরআনুল কারিমে এর ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, ‘ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। সুতরাং মন্দকে প্রতিহত করুন উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে আপনার ও যার মধ্যে শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো।’ (সুরা হা-মিম সাজদাহ : ৩৪)।
হাজারো শিক্ষিত হলেও চরিত্রহীন মানুষ পশুর চেয়েও অধম। তাই সমাজের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যন্ত সবাইকে চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করা অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে ইসলামি দাওয়াহর ক্ষেত্রে উত্তম চরিত্রের প্রভাব অপরিসীম। উত্তম চরিত্র ছাড়া ইসলামি দাওয়াহর কাজ কখনোই সম্ভব নয়। তাই রাসুল (সা.) এবং তার সাহাবীদের জীবনবৃত্তান্ত পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয়, তাঁদের মুখের দাওয়াতের চেয়ে তাদের নৈতিকতা ও আচরণই মানুষকে বেশি প্রভাবিত করেছে এবং এর ভিত্তিতেই অধিকাংশ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে। এজন্য একটি উত্তম আদর্শ ও মতবাদ প্রচার করতে হলে দায়িকে সর্বপ্রথম উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। আর উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে সব চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করতে হবে। নিম্নে কোরআন ও হাদিসের আলোকে উত্তম চরিত্রের গুণাবলির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো।
এক. তাকওয়া অর্জন করা
তাকওয়া হচ্ছে সৎচরিত্রের প্রথম সোপান। কেননা মানুষের গ্রহণযোগ্যতা আল্লাহর কাছে একমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতেই হয়। তাই সব ক্ষেত্রে আমাদের তাকওয়া অবলম্বন করা উচিত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে বেশি তাকওয়াসম্পন্ন।’ (সুরা হুজরাত : ১৩)।
দুই. সত্যবাদিতা অবলম্বন করা
সদা সত্য কথা বলা এবং মিথ্যা পরিহার করা উত্তম চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। কেননা তাকওয়ার উৎসারিত গুণ হলো সত্যবাদিতা। এটি এমন উচ্চস্তরের মানবিক গুণ যে, নবুওত পাওয়ার আগেই মহানবী (সা.) এ গুণ অবলম্বনের কারণে গোটা আরবে ‘আল আমিন’ হিসেবে পরম গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। কোরআন ও হাদিসে সত্যবাদিতা অবলম্বনের জন্য বিভিন্নভাবে আদেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সঠিক কথা বল।’ (সুরা আহজাব : ৭০)।
তিন. আমানতের খেয়ানত না করা
আমানত রক্ষা করা উত্তম চরিত্রের অন্যতম একটি গুণ। কেননা আমানত রক্ষার দ্বারা ব্যক্তির বিশ্বস্ততা অর্জন হয়। আর যার আমানতদারিতা নাই তার ঈমান পূর্ণতায় নেই। এজন্য মানুষের নিজের শরীর, ক্ষমতা, সম্পদ প্রভৃতি যেমন আল্লাহর কাছে আমানত ঠিক একইভাবে অন্য মানুষের জীবন সম্পদ ও সম্মান তার কাছে আমানত। তাই সৎচরিত্র অর্জনে কখনও আমানতের খেয়ানত করা যাবে না। মহান আল্লাহ তায়ালা হকদারের হক যথা সময়ে ফিরিয়ে দিতে আদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে ফিরিয়ে দিতে।’ (সুরা নিসা : ৫৮)।
চার. ওয়াদা পূর্ণ করা
উত্তম চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ওয়াদা পূর্ণ করা তথা প্রতিশ্রুতি পালন করা। আর প্রতিশ্রুতি পালনের মাধ্যমে যেমন ব্যক্তির মর্যাদা ঠিক থাকে তেমনি তার দ্বীনদারিও হেফাজতে থাকে। অথচ আমরা কথায় কথায় ওয়াদা করলেও তা ভঙ্গ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করি না। কিন্তু ওয়াদা পালন করতে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে জোর নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন করো। নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে তোমাদেরকে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩৪)।
পাঁচ. কথা কাজের মিল থাকা
যার কথা ও কাজের মিল নেই- মানুষের কাছে তার ব্যক্তি মর্যাদাও নেই। এজন্য কথা ও কাজের মিল রাখাও একটি উত্তম গুণ। আর কথা ও কাজের অমিল হলে মানুষের কাছে যেমন নিন্দনীয় হয়, তেমনি আল্লাহর কাছেও বড় অপরাধী বলে সাব্যস্ত হয়। যেমন আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা যা করো না তোমাদের তা বলা আল্লাহর দৃষ্টিতে খুবই অসন্তোষজনক।’ (সুরা সাফ : ০৩)।
ছয়. মিষ্টভাষী হওয়া
উত্তম চরিত্র অর্জনে বিনয়ী আচরণের কোনো বিকল্প নেই। কেননা বিনয়ী আচরণ উত্তম চরিত্রের সোপান। বিনয়ী ও হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে মানুষের সঙ্গে নরম ভাষায় কথা বলার মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা নবী মুসা ও হারুন (আ.) কে বলেছেন, ‘আপনারা তার (ফেরাউনের) সঙ্গে নরম ভাষায় কথা বলবেন, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।’ (সুরা ত্বহা : ৪৪)।
সাত. ক্ষমার নীতি অবলম্বন করা
উদারতা, ক্ষমাশীলতা উত্তম চরিত্রের একটি মহান গুণ। কেননা ক্ষমার দ্বারা যেমন চিরশত্রু অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যায় ঠিক তেমনি পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষও দূরীভূত হয়ে যায়। এ ছাড়াও ক্ষমাকারীকে যেমন আল্লাহ ভালোবাসে তেমনি মানুষও তাকে পছন্দ করে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; তাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে-ইমরান : ১৩৪)।
আট. আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখা
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে কাছে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কখনও দুর্ব্যবহার করা যাবে না। আত্মীয় স্বজন খারাপ ব্যবহার করলেও তাদের সঙ্গে করতে হবে ভালো ব্যবহার। কেননা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে রাসুল (সা.) নিষেধ করে বলেছেন, ‘যে তোমার সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে তুমি তার সঙ্গে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় কর।’ (আহমদ : ১৭৪৫২)।
নয়. শালীন জীবনযাপন করা
ইসলাম যেমন শালীন, শোভন ও সুন্দর জীবনযাপন করার আদেশ দিয়েছে, ঠিক তেমনি মন্দ ও অশালীন কাজ থেকেও দূরে থাকার আদেশ দিয়েছে। এজন্য কোন ঈমানদার মানুষ কখনও অন্যায়-অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে পারে না। কেননা অন্যায় অশ্লীলতা হচ্ছে বদ স্বভাবের মূল চাবিকাঠি। সুতরাং সব ধরনের অশালীন কাজকর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক, অশ্লীল কাজের ধারেকাছেও তোমরা যাবে না। ’ (সুরা আনয়াম : ১৫১)।
দশ. অহংকার না করা
অহংকার পতনের মূল। অহংকারী নিজেকে বড় মনে করলেও মানুষ তাকে ছোট মনে করে। অর্থাৎ প্রকাশ্যে মানুষ তাকে সম্মান করলেও গোপনে তাকে ঘৃণা করে। এজন্য নিজেকে বড় ভেবে অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে ইসলাম নিষেধ করেছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আর তুমি মানুষের প্রতি অবজ্ঞাভরে তোমার গাল বাঁকা কর না এবং যমীনে উদ্ধতভাবে বিচরণ কর না; নিশ্চয় আল্লাহ কোনো উদ্ধত, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লুকমান : ১৮)।
এগারো. কুধারণা থেকে বিরত থাকা
অসৎ চরিত্রের অন্যতম একটি গুণ হচ্ছে মানুষের ব্যাপারে সর্বদা কুধারণা পোষণ করা। অথচ কুধারণা সত্য হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে, তবে ধারণা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিথ্যা হয়ে যায়। তাই মহান আল্লাহ তায়ালা এমন বদ স্বভাব থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক; কারণ কোনো কোনো অনুমান পাপ এবং তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অন্যের গিবত করো না।’ (সুরা হুজরাত : ১২)।
উল্লিখিত চারিত্রিক গুণাবলি ছাড়াও আরও অনেক গুণাবলি আছে যেমন; ধৈর্য ধারণ করা, গোপনে প্রকাশ্যে দান সদকা করা, অযাথা তর্কবিতর্ক এড়িয়ে চলা, শোরগোল হট্টগোল না করা ইত্যাদি। শেষ কথা হলো উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে যেমন মোমিনের ঈমান পূর্ণ হয়, তেমনি নেকির পাল্লা ভারী হয় এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়া যায়। আল্লাহ আমাদেরকে উত্তম চরিত্র অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
