আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য অগণিত শুকরিয়া যে, তিনি আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইবাদত-বন্দেগি ও আনুগত্যের সঙ্গে সঙ্গে নবীজি (সা.) এর মহব্বতের ডোরে গেঁথে দিয়েছেন। নবীজির প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যই ঈমান। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেন, ‘হে নবী! আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তবে আমাকে অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১)। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হব।’ (বোখারি : ১৩-১৪)।
নবীজি (সা.) এর ভালোবাসার পূর্ণতা হলো আহলে বাইত, তথা নবী পরিবারের ভালোবাসায়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আপনি বলুন, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, চাই শুধু আমার স্বজনদের (আহলে বাইতদের) প্রতি ভালোবাসা।’ (সুরা শূরা : ২৩)। রাসুল (সা.) কোরাইশদের যে গোত্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন, তার প্রত্যেকটি শাখা-পরিবারের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার জন্মগত সম্পর্ক ছিল। তাই আল্লাহ বলেছেন, আপনি মুশরিকদের বলুন, দাওয়াতের জন্য আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না। আমি চাই, তোমরা আত্মীয়তার খাতিরে আমাকে তোমাদের মধ্যে অবাধে থাকতে দাও এবং আমার হেফাজত কর। ইবনে জারির প্রমুখ আরও বর্ণনা করেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যদি আমার অনুসরণে অস্বীকৃতিও জ্ঞাপন কর, তবুও তোমাদের সঙ্গে আমার যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে অন্তত তার প্রতি তো লক্ষ্য রাখবে। আরবের অন্যান্য লোক আমার হেফাজত ও সাহায্যে অগ্রণী হলে তোমাদের জন্য তা গৌরবের বিষয় হবে না। (তাফসিরে রুহুল মাআনি)।
আহলে বাইত বা নবী পরিবার দ্বারা উদ্দেশ্য
আহলে বাইত দ্বারা কারা উদ্দেশ্য, এ ব্যাপারে বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। ইকরিমা এবং মুকাতিল (রহ.) বলেন, আহলে বাইত দ্বারা শুধু নবীজির পুণ্যবতী স্ত্রীদের বোঝানো হয়েছে। কিন্তু হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায়, ফাতেমা, হাসান-হোসাইন (রা.)ও আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা রাসুল (সা.) বাড়ি থেকে বাইরে বের হচ্ছিলেন। সে সময় তিনি একটি কালো রুমি চাদর জড়ানো ছিলেন। এমন সময় সেখানে হাসান, হোসাইন, ফাতেমা ও আলী (রা.) এরা সবাই একের পর এক আসেন। নবীজি (সা.) এদের সবাইকে চাদরের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে নিয়ে উপরোক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত করেন। কোনো কোনো বর্ণনায় এরূপ রয়েছে যে, আয়াত তেলাওয়াত করার পর তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ! এরাই আমার আহলে বাইত।’ (ইবনে জারির)।
রাসুল (সা.) এর সম্মান ও মহব্বত সবকিছুর চেয়ে বেশি হওয়া আমাদের ঈমানের অঙ্গ ও ভিত্তি। অতঃপর রাসুল (সা.) এর সঙ্গে যার যত কাছে সম্পর্ক আছে, তার সম্মান ও মহব্বত এবং সে অনুপাতে জরুরি হওয়া অপরিহার্য। ঔরসজাত সন্তান সর্বাধিক নিকটাত্মীয়। তাই তাদের মহব্বত নিশ্চিতরূপে ঈমানের অঙ্গ। তবে এর অর্থ এই নয় যে, বিবিরা ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে যেতে হবে।
নবী পরিবারের মর্যাদা
নবী পরিবার ওইসব পবিত্র মানব যেভাবে নবী (সা.) সব নবী-রাসুলদের সরদার। ঠিক তেমনি নবীজির পরিবার-পরিজন সব নবী-রাসুলের পরিবারের সরদার। এদের শান ও মর্যাদা বর্ণনা করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো শুধু চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’ (সুরা আহযাব : ৩৩)। অন্য আয়াতে নবী পরিবারের প্রতি ভালোবাসার মর্যাদা এবং এর গুরুত্ব বর্ণনা করে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘অতঃপর আপনার কাছে সঠিক জ্ঞান আসার পর যারা আপনার সঙ্গে ঝগড়া করে, আপনি তাদের বলে দিন, আস আমরা ডাকি আমাদের সন্তানদের ও তোমাদের সন্তানদের, আমাদের মহিলাদের ও তোমাদের মহিলাদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের। অতঃপর আমরা আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করি, মিথ্যাবাদীদের ওপর অভিসম্পাত করি।’ (সুরা আলে ইমরান : ৬১)। এ আয়াতে খ্রিষ্টান পাদ্রিদের সঙ্গে রাসুল (সা.) এর সত্য-মিথ্যার প্রতিযোগিতার আহ্বান জানানো হয়। রাসুল (সা.) সমগ্র সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হাসান-হোসাইন-ফাতেমা-আলী এবং নিজেকে মোবাহেলার ময়দানে উপস্থিত করেন। সমগ্র সৃষ্টির শ্রেষ্ঠদের ভেতর থেকে নূরে মোহাম্মাদির তাজাল্লির বহিঃপ্রকাশ দেখে খ্রিষ্টান পাদ্রিরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। পাদ্রিরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করে বশ্যতা স্বীকার করে জিজিয়া কর দেবে এ শর্তে মদিনা ত্যাগ করে। ঘটনাটি রাসুলে পাকের ইন্তেকালের কিছু দিন আগে ঘটেছিল।
আল্লাহপাক আহলে বাইতের জন্য গনিমত এবং ‘ফাইয়ের’ মালে অংশ নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘আল্লাহপাক জনপদবাসীদের কাছ থেকে যা কিছু তার রাসুলকে দিয়েছেন, তা আল্লাহর, তাঁর রাসুলের আত্মীয়স্বজনের, এতিমদের এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের জন্য।’ (সুরা হাশর : ৭)। অন্যত্র আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘তোমরা জেনে রাখ যুদ্ধে গনিমতের যে মাল তোমরা লাভ কর, তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর রাসুলের, রাসুলের আত্মীয়স্বজনের, এতিমদের, দরিদ্রদের এবং মুসাফিরদের।’ (সুরা আনফাল : ৪১)।
তবে আল্লাহপাক আহলে বাইতকে সদকা এবং জাকাতের মাল থেকে পাক-পবিত্র রেখেছেন। রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, ‘আমার পরিবার-পরিজনের জন্য জাকাতের মাল হালাল নয়।’ ‘মাদারিজ’ নামক গ্রন্থে লেখা হয়েছে, ‘ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রা.) কে যখন আব্বাসি খলিফার নির্দেশে কোড়া মারা হলো, তখন তিনি সম্বিত ফিরে পেয়ে তাৎক্ষণিক বললেন, ‘হে লোক সব! তোমরা সাক্ষী থাকবে, আমি এ জুলুম ক্ষমা করে দিলাম। কারণ আমার লজ্জা হচ্ছে যে, হাশরের ময়দানে আমার কারণে আমার প্রিয়নবী (সা.) এর চাচার বংশধরদের কেউ যেন জবাবদিহির কাঠগড়ায় আটকা পড়ে না যায়!’ তাই সৈয়দ বা নবী বংশের সঙ্গে দূরতম সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদেরও সর্বোচ্চ সম্মান-আদব দেখাতে হবে। তাদের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা থাকা, প্রিয়নবী (সা.) এর প্রতি প্রেম-ভালোবাসারই একটা অংশ ও শাখাতুল্য। এটি মনে-প্রাণে বুঝে নিতে হবে। তাদের হাদিয়া-সম্মানি, উপহার প্রদান, তাদের অন্যান্য প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল রাখা নিজ দায়িত্ব বলে মনে করতে হবে। আর যারা সৈয়দ বা নবী বংশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হবেন, তাদেরও সব রকম অন্যায়-অপকর্ম থেকে বেঁচে থাকতে হবে। হ
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া
দারুল উলুম বাগে জান্নাত
চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ