প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০
আবু ওবায়দা বিন জাররাহ (রা.) মক্কার কোরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। ‘ফিহর বিন মালেক’-এ গিয়ে নবী (সা.) এর সঙ্গে তাঁর বংশধারা একীভূত হয়েছে। ইসলামের প্রথম যুগে নবীজি দারুল আরকামে প্রবেশের আগেই তিনিসহ ওসমান বিন মাজউন, ওবায়ে বিন হারেস, আবদুর রহমান বিন আউফ, আবু সালামা বিন আবদুল আসাদ ও আবু ওবায়দা বিন জাররাহ (রা.) একসঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেন।
তিনি জান্নাতি ১০ জন সাহাবির অন্যতম। নবীজি তাকে এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ আমানতদার ও বিশ্বস্ত বলে অভিহিত করেছেন। ১৭ রমজান ২ হিজরিতে সংঘটিত বদর যুদ্ধে তার পিতা কাফেরদের পক্ষ হয়ে এসেছিল। সেদিন ইসলামের স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি নিজেই পিতাকে হত্যা করেছিলেন।
বদর যুদ্ধে নবীজির মাথায় বিদ্ধ লোহার আংটা তিনি দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে বের করেছিলেন। এতে তার সামনের দুটি দাঁত গোড়া থেকে উপড়ে গিয়েছিল। তখন তাকে দাতহীন ফোকলা অবস্থায় চমৎকার বোকড়া দেখা যেত। তিনি ইথিওপিয়া ও মদিনায় হিজরত করেছিলেন। নবীজির যুগে পবিত্র কোরআন যারা সংকলন করেছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম।
খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাকে ইসলামি খেলাফত পরিচালনার উপযুক্ত বলে মনে করতেন। তাছাড়া প্রিয়নবী (সা.)ও তাকে খুবই ভালোবাসতেন। আমর বিন আস (রা.) বলেন, একদিন নবী (সা.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আপনার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে? তিনি বললেন, ‘আয়েশা’। বলা হলো, পুরুষদের মধ্যে কে? তিনি বললেন, ‘আবু বকর’। জিজ্ঞাসা করা হলো, তারপর কে? তিনি বললেন, আবু ওবায়দা বিন জাররাহ। অবশ্য উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেছেন, আবু বকরের পর নবীজির কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন ওমর বিন খাত্তাব, তারপর ছিলেন আবু ওবায়দা বিন জাররাহ।
তিনি বড় মাপের একজন সেনাপতি হয়েও নিজেকে খুবই তুচ্ছজ্ঞান করতেন। জাবের (রা.) বলেন, দামেশক অবরোধকালে আবু ওবায়দা যখন মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি, তিনি বহুদিন পর্যন্ত ক্ষমতার সঙ্গে দামেশক শহর অবরোধ করে রেখেছিলেন। তখন সাহায্যের জন্য খালেদের বাহিনী সেখানে প্রেরণ করা হয়েছিল। আমি খালেদের সঙ্গে ছিলাম। যখন সেখানে পৌঁছলাম, খালেদকে নামাজের ইমামতির জন্য আবু ওবায়দা অনুরোধ করে বললেন, আপনি নামাজ পড়ানোর বেশি যোগ্য। কারণ, আমি সাহায্যপ্রার্থী আর আপনি সাহায্যকারী।
খালেদ বললেন, এমন মহান ব্যক্তির সামনে ইমামতির জন্য কীভাবে দাঁড়াতে পারি, যাঁর সম্পর্কে প্রিয়নবী (সা.) কে বলতে শুনেছি, প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে একজন আমানতদার ও বিশ্বস্ত মানুষ থাকে। আর আমার উম্মতের মধ্যে আবু ওবায়দা সবচেয়ে আমানতদার ও বিশ্বস্ত।
মুসলিম বিন আকয়াস (রহ.) বলেন, একদিন আবু ওবায়দার কাছে গিয়ে দেখি তিনি কাঁদছেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আবু ওবায়দা, কাঁদছেন কেন? তিনি জবাব দিলেন, মুসলমানদের বিজয় ও ধনাঢ্যতা সম্পর্কিত নবীজির একটি উপদেশের কথা স্মরণ করে কাঁদছি। সিরিয়া বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখ করে তিনি বললেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘হে আবু ওবায়দা, তুমি যদি ওই সময় বেঁচে থাকো, তাহলে যেন তিনটি গোলাম ও তিনটি বাহন তোমার জন্য যথেষ্ট হয়। তোমার সফরের জন্য একটা গোলাম, আর দুটি গোলাম তোমার ও পরিবারের খেমতের জন্য। দুটি বাহন তোমার ও গোলামের আরোহণের জন্য, আরেকটি মালামাল বহনের জন্য।’
এরপর তিনি আফসোস করে বললেন, ‘কিন্তু’ আজ আমার বাড়িতে কত দাসী! আমার আস্তাবল ভর্তি কত অশ্বরাজি! আগামীকাল যখন নবীজির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে, তখন কীভাবে তাঁকে মুখ দেখাব! অথচ তিনি বলেছেন, তোমাদের মধ্যে আমার প্রিয়পাত্র ও নৈকট্যধন্য হবে তারাই, যারা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে এমন অবস্থায়, যেমন তাকে রেখে এসেছি।’
আসলে যেসব দাসী ও বাহনের কথা তিনি বলেছেন, সেগুলো মূলত তার ব্যক্তিগত ছিল না। বরং সেগুলো ছিল রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত। কিন্তু তিনি যেহেতু শাসক ছিলেন, তাই সেগুলো তার অধীন ছিল। এতেই তিনি এত ঘাবড়ে গেছেন। বাস্তবে তিনি ছিলেন একেবারে নির্মোহ ও স্বার্থত্যাগী একজন সাধারণ মানুষ। পার্থিব ভোগবিলাসের প্রতি তার কোনো আগ্রহই ছিল না। তার প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন স্বয়ং খলিফা ওমর বিন খাত্তাব।
আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) বলেন, খলিফা ওমর একবার সিরিয়ায় গেলেন। সেখানকার গভর্নর আবু ওবায়দার প্রকৃত অবস্থা অবলোকন করতে চাইলেন। তাই তাকে বললেন, আমাকে সরাসরি আপনার বাসগৃহে নিয়ে চলুন। আবু ওবায়দা বললেন, আমার বাসগৃহে গিয়ে খলিফা কী করবেন? হয়তো আপনি শুধু চোখযুগল সিক্ত করতে চাইছেন। তার বাসগৃহে প্রবেশ করে সেখানে তেমন কিছু দেখতে পেলেন না। তাই তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার আসবাবপত্র কোথায়? আমি যা দেখলাম, তা তো হচ্ছে একটি বাটি, একটি বোল আর একটি শানকি। আপনার কাছে কি কোনো খাদ্য প্রস্তুত আছে?
খলিফার কথা শুনে আবু ওবায়দা একটা পাত্র এনে দিলেন, যাতে কয়েকটি শুষ্ক রুটির টুকরো ছিল। তা দেখে খলিফা কেঁদে দিলেন। আবু ওবায়দা বললেন, আমি তো আগেই বলেছিলাম, আমার অবস্থা দেখলে হয়তোবা খলিফার চোখযুগল সিক্ত হয়ে যাবে। খলিফা ওমর (রা.) বললেন, পার্থিব ভোগবিলাস আমাদের অবস্থা পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু হে আবু ওবায়দা, দুনিয়ার মোহ আপনাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
আসলে ভোগবিলাসিতার ক্ষমতা থাকতে তা বিসর্জন দেওয়াই প্রকৃত ‘জুহদ’ বা স্বার্থত্যাগ। পাপাচারের সামর্থ্য থাকতে তা ত্যাগ করা হলো তাকওয়া। আর আত্মীয়তা ছিন্নকারীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টাকে বলে প্রকৃত সম্পর্করক্ষা। ফকিরের নিঃস্বতা জুহদ নয়।
খলিফা ওমর বিন খাত্তাব একবার আবু ওবায়দা ও মুয়াজ বিন জাবালের কাছে হাদিয়াস্বরূপ ৪০০ বা চার হাজার দিনার করে প্রেরণ করেছিলেন। দূতকে বলেছিলেন, তুমি দেখে আসবে, তারা এই মুদ্রাগুলো দিয়ে কী করেন। আবু ওবায়দা সবগুলো মুদ্রা গরিব-দুস্থদের মধ্যে বণ্টন করেছিলেন। আর মুয়াজ বিন জাবাল স্ত্রীর আবেদনে যৎসামান্য রেখে পুরোটাই দান করেছিলেন। খলিফা ওমর দূত মারফত তা জানতে পেরে এভাবে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন যে, ‘আলহামদুলিল্লাহ, তিনি ইসলাম ধর্মে এমন নিঃস্বার্থ মানুষ সৃষ্টি করেছেন।’
আবু ওবায়দা ছিলেন একজন অমায়িক মানুষ। ছিলেন ধৈর্যশীল, বিনয়ী ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তার সদ্গুণে খলিফা ওমরসহ অন্যরা মুগ্ধ ছিলেন। একদিন খলিফা ওমর বিন খাত্তাব (রা.) লোকদের বললেন, তোমাদের যার যার মনোবাঞ্ছা ব্যক্ত করো। সবাই নিজের মনোবাঞ্ছার কথা প্রকাশ করল। সবার কথা শুনে ওমর (রা.) বললেন, ‘কিন্তু আমার মনোবাঞ্ছা হচ্ছে, আবু ওবায়দার মতো মহামানুষে সবার ঘর ভরে উঠুক।’ আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বলেছেন, আমি তিন ব্যক্তিকে বন্ধু বানানো পছন্দ করি আবু বকর, ওমর ও আবু ওবায়দা।
আবু ওবায়দা বিন জাররাহ (রা.) ১৮ হিজরি সনে আমাওয়াস মহামারিতে সিরিয়ায় ইন্তেকাল করেন। তখন ওমর (রা.) এর শাসনকাল। তিনি তাঁকে মদিনায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাহাবিরা কেউ নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেন না। সঙ্গীদের বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে নিজে বেঁচে যাবেন, তারা তা কখনও পছন্দ করতেন না। বরং সবসময় তারা নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অপর মুসলমানকে রক্ষা করার চেষ্টা করে গেছেন।
আবু মুসা আশয়ারি (রা.) বলেন, সিরিয়ায় যখন মহামারি ছড়িয়ে পড়ল, তখন আবু ওবায়দার কাছে ওমর (রা.) চিঠি লিখলেন। ‘আমি আপনাকে নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা করেছি। কাজেই আমার এই চিঠি পৌঁছামাত্র আপনি রওনা করবেন। সকালে পৌঁছলে সন্ধ্যা হওয়ার আগে আমার কাছে রওনা করবেন। আর সন্ধ্যায় পৌঁছলে সকাল হওয়ার আগে রওনা করবেন। আপনাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন। আপনি ছাড়া তা পূরণ হওয়ার নয়।’
আবু ওবায়দা (রা.) এই চিঠি পেয়ে মন্তব্য করলেন, ‘আমিরুল মুমিনিন এমন একজনকে রেখে দিতে চাইছেন, যে আসলে শেষ হয়ে গেছে।’
আবু ওবায়দা তার চিঠির জবাবে লিখলেন, ‘আমি এখন মুসলিম বাহিনী নিয়ে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তাদের রেখে আমার একা ফিরে যেতে মন চাইছে না। আমিরুল মুমিনিনের প্রয়োজন আমার বুঝে এসেছে। আমাকে দয়া করে আপনার সংকল্প থেকে মুক্তি দিন।’
চিঠির এই জবাব পেয়ে ওমর (রা.) কেঁদে ফেললেন। দূতকে জিজ্ঞাসা করলেন, আবু ওবায়দা কি মারা গেছেন? দূত বলল, তিনি এখনও মরেননি ঠিক; কিন্তু সময় আসন্ন। মহামারিতে মারা গেলে শহীদি মৃত্যু। তাই আবু ওবায়দা আল্লাহর কসম করে বললেন, এটা আমার কাছে মহানেয়ামত। এর বিপরীতে আরবের লাল রঙের প্রিয় উটকেও আমি প্রাধান্য দেব না। [সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১/১, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ৩৮৬৩, সাকবুল আবারাত : ১/১৪৫]।