ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫, ৩০ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হানাফি মাজহাবের কিংবদন্তি ইমাম তহাবি (রহ.)

নূর মুহাম্মদ রাহমানী
হানাফি মাজহাবের কিংবদন্তি ইমাম তহাবি (রহ.)

তৃতীয় শতাব্দীর অন্যতম মুজতাহিদ আলেম, হানাফি মাজহাবের কিংবদন্তি ও প্রাজ্ঞ লেখক ইমাম আবু জাফর তহাবি (রহ.)। অসাধারণ ধীমান প্রতিভা। ইতিহাসের স্তম্ভ পুরুষ। বিচিত্রধর্মী অসাধারণ গুণাবলীর অধিকারী এক মহামনীষী। পৃথিবীতে এমন লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম। একদিকে তিনি হাদিস শাস্ত্রের নক্ষত্র ও বরিত ফকিহ। অপরদিকে তিনি একজন সরকারি আদালতের মহামান্য বিচারক। ২৩৯ হিজরির ১১ রবিউল আওয়াল রবিবার সন্ধায় মিসরের একটি সুবিখ্যাত গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। নিজস্ব বাসস্থান মিসরের তাহা গ্রামের প্রতি সম্পৃক্ত করে তাকে তহাবি বলা হয়। ইমাম সামআনি (রহ.) এমনটিই বলেছেন। পিতার দিক থেকে তিনি ছিলেন ইয়ামানের সুবিখ্যাত আযদ (কাহ্তান) গোত্রের, আর মায়ের দিক থেকে মুমায়না (আদনান) গোত্রের। ফলে তাঁর ধমনী ও শিরা উপশিরায় দক্ষিণ এবং উত্তর উভয় আরবেরই রক্ত সমভাবে বহমান।

জ্ঞান সম্রাট ইমাম তহাবি (রহ.) মুহাদ্দিস পিতা এবং ফকিহা মায়ের সন্তান। তাই হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্র তিনি উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত। সেকালের চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে পিতৃগৃহেই লাভ করেন প্রাথমিক শিক্ষা। এর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা লাভ করেন তিনি কোরআনের দশটি পঠন পদ্ধতি কেরাতে আশারাহ। কারি আসেম (রহ.) এর কেরাত রাওহুব-নুল-ফারজ থেকে শিক্ষা লাভ করেন অক্ষরে অক্ষরে। অতঃপর তিনি সে যুগের অন্যান্য শিক্ষানবিশদের ন্যায় কিছু হাদিস মুখস্থ করেন এবং ফিকহের প্রাথমিক বিষয় ও আরবি ব্যাকরণের জ্ঞান লাভ করেন। গৃহশিক্ষা শেষে জ্ঞানের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র ইমাম তহাবি (রহ.) উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশে গ্রামীণ পরিবেশ থেকে শহরে আগমন করেন। মিসরের খ্যাতিসম্পন্ন ও প্রথিতযশা আলেম, কালজয়ী মুহাদ্দিস ও ফকিহ আবু ইবরাহিম মুযানি (রহ.) ছিলেন তহাবির মামা। মামার কাছেই পরবর্তী সময়ের শিক্ষা শুরু। তার কাছে হাদিস এবং শাফেয়ি ফিক্হ শাস্ত্র অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করতে থাকেন। সে যুগের বেশ নামকরা কিতাব ছিল ইমাম শাফেয়ির ‘মুসনাদ’। এটি ইমাম মুযানির মাধ্যমেই বর্ণিত। তিনি মামার কাছে এ গ্রন্থ শ্রবণ করেন।

ইমাম তহাবি (রহ.) মামা ইমাম মুযানি (রহ.) এর কাছে অধ্যয়ন করতেন। ইমাম মুযানি (রহ.) ছিলেন শাফেয়ি মাজহাবের অধিকারী। তাই শিক্ষাগুরু মামার অনুসরণে তিনিও শাফেয়ি মাজহাবে দীক্ষিত ছিলেন। পরবর্তীতে হানাফি মাজহাবে দীক্ষিত হন। মাজহাব পরিবর্তনের রয়েছে এক রহস্যময় কারণ আবু আলি খলিলি ‘কিতাবুল ইরশাদ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, মুহাম্মদ ইবনে আহমদ শুরুতি একদিন ইমাম তহাবি (রহ.) কে মামার বিরোধিতা করে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মাজহাব গ্রহণ করার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তখন এই প্রশ্নের জবাবে ইমাম তহাবী (রহ.) বলেন, আমি মামাকে সর্বদাই ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর গ্রন্থাবলি অতি মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করতে দেখতাম। একারণেই আমি ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মাজহাবে পরিবর্তিত হই। মাওলানা ফকির মুহাম্মদ যাইলামি (রহ.) এ ঘটনাটি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন এইভাবে ইমাম তহাবি একদিন মামার কাছে পড়ছিলেন। ক্লাসে একটি মাসয়ালা এলো যদি কোনো অন্তঃসত্তা¡ নারী মারা যায়, আর তার পেটে বাচ্চা জীবিত থাকে তাহলে ইমাম শাফেয়ি (রহ.) এর মতে উক্ত নারীর পেট বিদীর্ণ করে বাচ্চা বের করা বৈধ নয়। কিন্তু হানাফি মাজহাব এর ব্যতিক্রম। তিনি এটা পড়তেই দাঁড়িয়ে বললেন, আমি সেই ব্যক্তির অনুসরণ করবো না, যে কিনা আমার ন্যায় ব্যক্তির ধ্বংসের পরোয়া করবে না। কেননা তিনি তার মায়ের পেটে থাকাবস্থায়ই তার মা মারা গিয়েছেন এবং তার পেট বিদীর্ণ করে তাকে বের করা হয়েছে। এ অবস্থা অবলোকন করে মামা তাকে বললেন, আল্লাহর কসম! ‘তুমি কস্মিনকালেও ফকিহ হবে না।’ পরবর্তী সময়ে তিনি যখন আল্লাহর অনুগ্রহে হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম ও মুজতাহিদের ন্যায় সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হন তখন প্রায়ই বলতেন, আমার মামাকে আল্লাহ রহমত করুন! যদি তিনি আজ জীবিত থাকতেন তাহলে স্বীয় মাজহাব মতে অবশ্যই নিজের কসমের কাফফারা আদায় করতেন।

ইমাম তহাবি (রহ.) মামার কাছে থেকে চলে যাওয়ার পর হানাফি মাজহাবের যে সব বিশেষ আলেমের সংস্পর্শে আসেন তাদের মধ্যে কাজি বাক্কার ইবনে কুতাইবা এবং আহমদ ইবনে আবু ইমরান সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। কাজি বাক্কারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল খুবই গভীর। তার কাছে থেকে বহু জ্ঞানমূলক বিষয়ের শিক্ষা নেন। তার অপর শিক্ষক আহমদ ইবনে আবু ইমরান মুসা ছিলেন বিশিষ্ট ফকিহ। তার কাছ থেকে অর্জন করেন ফিকহ শাস্ত্রের অগাধ জ্ঞান।

ইমাম তহাবি (রহ.) কে হানাফি মাজহাবের লালনক্ষেত্র ইরাক সফর করতে হয়নি। কারণ তৎকালীন যুগে হানাফি মাজহাবের বিশিষ্ট ফকিহ কাজি বাক্কার, ইবনে আবু ইমরান প্রমুখের কাছে তিনি হানাফি ফিকহের জ্ঞান লাভ করেন। ফলে আর ইরাক যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। ইমাম তহাবি (রহ.) ইলমুশ শুরুত, সিজিল্লাত এবং শাহাদাত এক কথায় উকালতি বিষয়ে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করেন। এ কারণে বিভিন্ন যুগে মিসরের সম্মানিত কাজিরা তাকে সেক্রেটারি এবং নায়েবে কাজি নিযুক্ত করেন। ইমাম তহাবি (রহ.) এর জীবনচরিতে আমরা দেখতে পাই, তার জীবন ছিল অত্যন্ত কর্মবহুল। সর্বদা সমাজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন এবং জীবনের একটি বিরাট অংশ বিচারালয়ে কাটিয়েছেন।

ইমাম তহাবি (রহ.) মামা ইমাম মুযানি (রহ.) এর মধ্যস্থতায় ইমাম শাফেয়ি (রহ.) এর শাগরেদ আর এ দু’জনের মাধ্যমে ইমাম মালেক (রহ.) এবং ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) এর শাগরেদ আর এ তিনজনের মাধ্যমে ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) এরও তিনি ছাত্র। সরাসরি উস্তাদ সংখ্যা তো অসংখ্য। ইমাম তহাবি (রহ.) তৎকালের মুসলিম জাহানের প্রখ্যাত হাদিস কেন্দ্রগুলো সফর করে হাদিস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেছেন। মিসর, ইয়ামান, হিজায, শাম, খোরাসান, কুফা, বসরা, রায় ও ইরাকে হাদিস সংগ্রহের জন্য বছরের পর বছর মুহাদ্দিসদের দ্বারে দ্বারে ফিরেছেন। সঞ্চয় করেছেন সুবিন্যস্তভাবে অমূল্য রতভার নিরলস সাধনায়।

ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইমাম তহাবি (রহ.) এর অবদান অনস্বীকার্য। ফিকহ, আকাইদ, ইতিহাস, জীবনীগ্রন্থ প্রভৃতি বিষয়ে রচিত রচিত গ্রন্থগুলো তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে। তার গ্রন্থের তালিকা অনেক বিশাল। তবে আহকামুল কোরআন, মুশকিলুল আসার এবং মুখতাসারুত তাহাবি গ্রন্থগুলো অত্যধিক প্রসিদ্ধ। ক্ষণজন্মা এই আলেমেদীন ৮২ বছর বয়সে ৩২১ হিজরির ৩০ শাওয়াল বৃহস্পতিবার রাতে ইন্তেকাল করেন।

(যাফারুল মুহাসসিলিন ও ইমাম তাহাভী (রহ.) জীবন ও কর্ম, ড. মুহাম্মদ শফিকুল্লাহকৃত অবলম্বনে রচিত)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত