ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ফুটবলে নবজাগরণ, বদলেছে খেলা বেড়েছে আয়

ফিরে দেখা ২০২৫
ফুটবলে নবজাগরণ, বদলেছে খেলা বেড়েছে আয়

দিন যায় দিন আসে, মাস যায় মাস আসে, বছর গড়িয়ে আসে বছর। সময় যেন এক প্রবহমান মহাসমুদ্র। কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে আরও একটি বছর। দেখতে দেখতে কেটেছে দিন; ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এখন সময় এসেছে ক্যালেন্ডার বদলানোর। আর এই বিদায়ী বছরে দেশের ফুটবলে নবজাগরণ ঘটেছে। যার মূলে রয়েছেন কয়েকজন প্রবাসী ফুটবলার। যার অন্যতম ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা হামজা চৌধুরী। তার আগমণে নতুন করে জেগে উঠেছে দেশের ফুটবল। প্রায় দুই যুগ পর ভারতের বিপক্ষে জয়ের স্বাদ পেয়েছে লাল সবুজের ফুটবল দল। পিছিয়ে নেই নারী ফুটবলও। প্রথমবার এএফসি এশিয়ান কাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে তারা। তবে নারী ফুটবলে বিদ্রোহের ঘটনাও ঘটেছে।

২০২৫ সাল ছিল বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য অত্যন্ত ঘটনাবহুল। মাঠের খেলা যেমন বদলেছে, তেমনি বদলে গেছে দেশের ফুটবলের ডিজিটাল সম্প্রচার আর স্পন্সরশিপের চিত্রও। জার্সির বাজারেও ঘটে গেছে বিপ্লব। বাংলাদেশ ফুটবলে বদলে যাচ্ছে আয়ের চিত্র। ডিজিটাল রাইটস আর পৃষ্ঠপোষকতায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ডিজিটাল যুগে বাংলাদেশ ফুটবল এখন এগোচ্ছে নতুন বাজার বাস্তবতার দিকে।

বাংলাদেশের জার্সিতে হামজা, সামিত : ২০২৫ সাল বাংলাদেশের ফুটবলে বিশেষ এর প্রধান কারণ ইংলিশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে খেলা ফুটবলার হামজা চৌধুরীর আগমন। হামজা মার্চে বাংলাদেশের হয়ে খেলতে প্রথম দেশে আসেন। তখন থেকেই বাংলাদেশের ফুটবল উন্মাদনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। ২৫ মার্চ ভারতের বিপক্ষে শিলংয়ে বাংলাদেশের জার্সিতে হামজার অভিষেক হয়। এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে হামজার ম্যাচ দেখার জন্য উপচেপড়া দর্শক ছিল প্রতি ম্যাচেই। টিকিট ছাড়ার কয়েক মিনিট পরই বিক্রি হওয়ার ঘোষণা এসেছে। যদিও টিকিট বণ্টন ও প্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন ছিল বরাবরই। হামজা চৌধুরী মার্চে খেলার পর জুনে বাংলাদেশের জার্সিতে খেলেন সামিত সোম। যিনি কানাডা জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন এক সময়। হামজা-সামিত বাংলাদেশ দলে যোগ দেওয়ায় ফুটবল উন্মাদনায় বাড়ে বহুগুণে।

ফাহামিদুল ও ক্যাবরেরাকে নিয়ে সমর্থকদের আন্দোলন : ইতালিয়ান প্রবাসী ফাহমিদুল ইসলামকে ভারতের বিপক্ষে প্রাথমিক স্কোয়াডে ডেকেছিলেন কোচ হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরা। সৌদি আরবের ক্যাম্প থেকে দেশে ফেরার সময় ফাহমিদুলকে আনেননি ক্যাবরেরা। এরপরই সমর্থকরা তাকে দলে ফেরানোর জন্য আন্দোলন করে। ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বাফুফে সভাপতিকে তলব করেন এই ইস্যুতে। মার্চে ফাহামিদুলকে না খেলালেও জুনে সিঙ্গাপুর ম্যাচে একাদশে রাখেন ক্যাবরেরা। জুনের ম্যাচে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে বাংলাদেশ পরাজিত হয়। এজন্য কোচের ভুল কৌশলকে দায়ী করেন ফুটবলসংশ্লিষ্টরা। বাফুফে নির্বাহী সদস্য সাখওয়াত হোসেন ভূঁইয়া শাহীন এক অনুষ্ঠানে ক্যাবরেরার পদত্যাগ দাবি করেন প্রকাশ্যে। কোড অফ কন্ডাক্ট বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে জাতীয় দল কমিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ এশিয়া কাপে খেলতে না পারায়। বছরজুড়েই হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরাকে নিয়ে সমর্থকদের আন্দোলন হয়েছে। তাকে পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন সমর্থকরা। হামজা-সামিতের মতো ফুটবলার বাংলাদেশ দলে আসার পরেও বাংলাদেশ এশিয়া কাপে খেলতে পারেনি। সাবেক ফুটবলার, কোচরাও বাংলাদেশের ব্যর্থতার জন্য ক্যাবরেরাকে দায়ী করেছেন। ফেডারেশনের কয়েকজন সদস্যও তার পদত্যাগ চেয়েছেন। এরপরও জাতীয় দল কমিটির সভায় তাকে রাখা না রাখা নিয়ে তেমন আলোচনাই হয়নি।

সাবিনাসহ ১৮ ফুটবলারের বাটলার বিদ্রোহ : নতুন বছরের শুরুই হয়েছিল ফুটবলে নারী ফুটবলারদের বিদ্রোহ দিয়ে। ৩০ জানুয়ারি সাবিনা, কৃষ্ণা, সানজিদা ও ঋতুপর্ণাসহ ১৮ জন ফুটবলার কোচ পিটার বাটলারের ওপর বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বাটলারের অধীনে তারা খেলবেন না এমন অবস্থান নেন। তারা বাটলারকে নিয়ে লিখিত অভিযোগও দেন। ফেডারেশন ফুটবলারদের চিঠির ভিত্তিতে বিশেষ কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি সভাপতি বরাবর প্রতিবেদন দেয়। সভাপতি তাবিথ আউয়াল কোচণ্ডফুটবলারদের সঙ্গে বারংবার বৈঠক করে। পরবর্তীতে ফুটবলার ও কোচ দুই পক্ষই নমনীয় হয়। ঋতুপর্ণারা বাটলারের অধীনে খেলা শুরু করেন। তবে সাবিনা, কৃষ্ণা, মাসুরা, সানজিদা ও সুমাইয়া এই পাঁচজন ফুটবলারকে আর ডাকেননি কোচ বাটলার। তারা এখন বাধ্য হয়ে ফুটসালে মনোযোগী হয়েছেন।

এক বছরে দুই নারী এশিয়া কাপ : নারী ফুটবলে বছর শুরু হয়েছিল বিদ্রোহ-আন্দোলন দিয়ে। এই বছরেই এসেছে দু’টি ঐতিহাসিক অর্জন। প্রথমবারের মতো সিনিয়র ও অনূর্ধ্ব-২০ দল এশিয়া কাপের মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। সাবিনা ও মাসুরাদের মতো অভিজ্ঞ ফুটবলার বাদ দিয়ে বাংলাদেশ এশিয়ান কাপ বাছাই খেলতে মিয়ানমার সফরে যায়। সেই সফরে র‍্যাংকিংয়ে ৫৫ নম্বর অবস্থানে থাকা মিয়ানমারকে ১-২ গোলে হারিয়ে এশিয়া কাপ নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। দু’টি গোলই করেন ঋতুপর্ণা চাকমা। পরের মাসেই লাওসে অ-২০ নারী দল সেরা তিন রানার্স-আপ হয়ে এএফসি অ-২০ টুর্নামেন্টে খেলা নিশ্চিত করে। এএফসির টুর্নামেন্টের আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ অ-২০ টুর্নামেন্টেও চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।

ফিফা র‍্যাংকিং শিরোনামে বাংলাদেশ : জুন মাসে বাংলাদেশ প্রথমবার এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। এতে ফিফা র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ২৪ ধাপ উন্নতি করে ১০৪ এ উন্নতি করে। ফিফা র‍্যাংকিং শিরোনামে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করেছে। এটা বাংলাদেশের কখনো আগে হয়নি। এশিয়া কাপ নিশ্চিত হওয়ার পর বাংলাদেশ নারী দল আর জয় পায়নি। থাইল্যান্ডে দুই ম্যাচে ৮ গোল। ঢাকায় উজবেকিস্তান ও মালয়েশিয়ার বিপক্ষে দুই ম্যাচ হেরে র‍্যাংকিংয়ে ৮ ধাপ পিছিয়েছে।

ফুটসালে বাংলাদেশ : ফুটবলের অন্য এক ভার্সন ফুটসাল। সংক্ষিপ্ত আয়তন ও স্বল্প সংখ্যক ফুটবলারের এই প্রতিযোগিতা বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন এই প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিক আসরে অংশগ্রহণ করেনি। বাফুফের নতুন কমিটি ফুটসালে গুরুত্বারোপ করেছে। এশিয়ান ফুটসালের বাছাইয়ে বাংলাদেশ এবার প্রথম অংশগ্রহণ করে। সাত বছর নারী ফুটসাল দলও পুনরায় তৈরি করা হয়েছে।

২২ বছর পর মোহামেডানের লিগ শিরোপা : দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় ক্লাব ঢাকা মোহামেডান। সেই মোহামেডান ২০০২ সালের পর প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। ২২ বছর পর ২০০৫ সালে তারা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃত্তিত্ব অর্জন করেন। চ্যাম্পিয়ন হয়েও মোহামেডান এএফসির টুর্নামেন্টে খেলতে পারেনি ক্লাব লাইসেন্সিং না থাকার কারণে। মোহামেডানের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অন্যতম নায়ক মালির ফুটবলার সুলেমান দিয়াবাতে। তাকে চলমান মৌসুমে রাখতে পারেনি মোহামেডান। ঢাকা আবাহনীর হয়ে খেলছেন তিনি।

ফিফার নিষেধাজ্ঞায় মোহামেডান, আবাহনী ও কিংস

২০২৫ সাল বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য নিষেধাজ্ঞার বছর। বছরের শুরুতে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব বিদেশি ফুটবলারদের টাকা পরিশোধ না করায় ফিফা খেলোয়াড় নিবন্ধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর বসুন্ধরা কিংসের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আসে। সর্বোচ্চ সাতটি নিষেধাজ্ঞা এসেছে কিংসের ওপর। মোহামেডানের একটি ও আবাহনীর ওপর তিনটি নিষেধাজ্ঞা এসেছে। দলবদল শুরুর আগে ফকিরেরপুলের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছিল। উজবেক ফুটবলারের বকেয়া অর্থ পরিশোধ করায় ফিফা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হওয়ায় দলবদলে অংশগ্রহণ করতে পেরেছে।

এএফসি অ্যাওয়ার্ড বাফুফে : বাফুফে এএফসি প্রেসিডেন্টস গ্রাসরুট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। গ্রাসরুট ডে’তে যশোরের শামসুল হুদা একাডেমিতে হাজার জনের উপর ক্ষুদে ফুটবলার এসেছিল। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সাফ পর্যায়ে সফল হয়েছে। বয়সভিত্তিক দলকে বাফুফে চীন পাঠিয়েছিল। যশোরের শামসুল হুদা একাডেমিতে বছরজুড়েই ফুটবলারদের অনুশীলনে ছিল।

স্পন্সর অনেক, ঘরোয়া ফুটবলে মন্থরতা : মাঠে ফলাফল যাই হোক ২০২৫ সালের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে বাণিজ্যিক খাতে। ডিজিটাল রাইটস, স্পন্সরশিপ, আর টেকনোলজি— এ তিন মিলেই বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফুটবলের আর্থিকভিত্তি। আর সেখানেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের বড় স্বপ্ন আরও বড় লিগ, আরও স্বচ্ছল ক্লাব, আর বিশ্বমঞ্চে প্রতিযোগিতামূলক বাংলাদেশ। হামজা-সামিত আগমন এবং নারী ফুটবলারদের সাফল্যে ফুটবলে এখন স্পন্সর অনেক। স্টিল কোম্পানির সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি হয়েছে। এত দীর্ঘমেয়াদি স্পন্সর বাফুফেতে কখনও ছিল না। বাংলাদেশের হোম ম্যাচগুলোতে অনেক স্পন্সর এসেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত