ঢাকা শনিবার, ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মাটিতে দাফনে বিজ্ঞান ও হিকমত

মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)
মাটিতে দাফনে বিজ্ঞান ও হিকমত

মুসলমানদের মাটিতে দাফন করার বহুবিধ হিকমত রয়েছে- যেমন লাশ দাফন একদিকে যেমন মৃতের পক্ষে পর্দা হয়ে থাকে, অপরদিকে যারা জীবিত আছে তাদের জন্যও কোনো কষ্টের কারণ হয় না।

পক্ষান্তরে লাশ যদি মাটির নিচে দাফন না করে পানি ও বাতাসে রাখা হয়, তাতে নাক ও চোখের অতিরিক্ত কষ্ট হয়। নাকের কষ্ট হয় দুর্গন্ধের কারণে, চোখের কষ্ট হয় এই অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখার কারণে। ঘৃণার কষ্ট তো আছেই। আগুনে পোড়ানোর সময় যে বীভৎস চিত্রের প্রকাশ ঘটে, তা যারা পোড়ায় এবং এর আশপাশে অবস্থান করে তারা খুব ভালো বলতে পারবে, মানব দেহের লাশের প্রতি কী অমানবিক আচরণের চিত্রায়ন। তাছাড়া বাতাস নষ্ট হওয়ার দ্বারা পানি নষ্ট হওয়া এবং রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হওয়ার শুধু আশঙ্কা রয়েছে। ফলে মানব সৃষ্টির মূল উপাদান নষ্ট হওয়ার যে ক্ষয়ক্ষতি তা তো রয়েছেই। পক্ষান্তরে দাফন করা হলে এসব ক্ষতির কোনোটাই পরিলক্ষিত হয় না। বরং দেহের জোড়াগুলো খুলে যাওয়ার কারণে মৃতদেহের মূল উপাদান চতুষ্টয় স্বীয় স্থানে ফিরে আসে। তাতে মাটি, পানি, বাতাস ও আগুন আগে যে পরিমাণ ছিল, সর্বাদা সে পরিমাণই অবশিষ্ট থাকে।

আগুনের উত্তাপে জমির উর্বরা শক্তির যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তা খুবই স্পষ্ট। অনুরূপভাবে মৃতব্যক্তিকে মাটিতে দাফনের ফলে উর্বরাশক্তি কী পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তাও কারও কাছে অস্পষ্ট নয়।

আগুনের উত্তাপে উৎপাদন শক্তির ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি তো এমনিতেই বুুঝা যায়। কেননা, যেখানে আগুন জ্বালানো হয়, সেখানে শাকসবজি ও তরুলতা উৎপন্ন হয় না। বাকি দাফনের ফলে উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হলো, মানব দেহ এমন একটি বস্তুজাত অবয়ব, যা মাটি থেকে উৎপন্ন ফলমূলের উপাদানের সাহায্যে তৈরি হয়। সুতরাং ফলমূল ও খাদ্যদ্রব্য থেকে যদি মানব দেহ তৈরি হয়, তা হলে তাতে শক্তি সঞ্চার হওয়া স্বয়ং উৎপাদন শক্তির কাজ। এ শক্তির সাহায্যে খাদ্যদ্রব্যে রং, স্বাদ ও গন্ধ সৃষ্টি হয়।

মোটকথা উৎপাদন শক্তিই বেশ কসরত করে জমি থেকে শোষণ করে এ সমস্ত বস্তু বের করে থাকে। মাটির নিচে এগুলো একাকার হয়ে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে মিশে যায়। অতএব, যদি কবরস্থান ও এর আশপাশে উৎপাদন অধিক হয় তাহলে অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা, মানব দেহের মূল চালিকাশক্তি খাদ্য থেকে তৈরি হয় এবং উক্ত খাদ্যের নির্যাস জমির উৎপাদনশক্তিকে এত বৃদ্ধি করে, মানবদেহ যা এর চেয়ে অধিক শক্তিশালী। আর এতে কেনই-বা এ শক্তি থাকবে না, অথচ এটি পানি, মাটি, আগুন ও বাতাস এর চার উপাদান দ্বারা তৈরি।

ফলকথা, আগুনের শক্তি হলো জ্বালানো আর মানবদেহে শক্তি সঞ্চার হওয়ার বিষয়টি মাটির ব্যাপারে নিশ্চিত। তাই তো দেখা যায়, হিন্দুদের শ্মশানে কোনো শাক-সবজি বা তরুলতার কোনো নামণ্ডনিশানাও থাকে না। পক্ষান্তরে মুসলমানদের কবরস্থানে সর্বত্র চোখে পড়ে সবুজের সমারোহ।

সাধারণত একজন কল্যাণকামী পিতা সফরে গমনকালে সন্তাকে স্নেহময়ী মায়ের কাছে রেখে যান, মায়ের সতীনের কাছে নয়। যদি তা-ই হয়, তবে মাটির দেহকে আগুনে সোপর্দ না করে মাটিতেই সোপর্দ করা ন্যায়সঙ্গত। মোটকথা, মাটির তৈরি দেহের জন্য রূহ বা আত্মা হলো প্রতিপালকস্বরূপ। সুতরাং তার লালন-পালন ও দেখভালের দৃশ্য স্পষ্ট। আর মাটির এ পৃথিবী তার জন্য স্নেহময়ী মায়ের মতো। সুতরাং মাটি থেকে এর সৃষ্টি হওয়া খোদ এ কথারই প্রকৃষ্ট সাক্ষী। অতএব, (রূহ) উর্ধ্বজগতে চলে যাওয়ার সময় মাটির এ দেহ মাটিতে দাফন না করে যদি আগুনে সমর্পণ করা হয়, তবে এর দৃষ্টান্ত হবে নিজের সন্তানকে মায়ের কাছে না রেখে তার সতীনের কাছে সমর্পণ করার মতোই।

চুরি বাতীত কারো কবুতরের ঝাঁকে যদি অন্য কারো কবুতর এসে মিশে যায় অথবা একজনের বকরির পালে যদি অন্যজনের বকরি ঢুকে পড়ে, তবে অন্যের কবুতর ও বকরিগুলো পৃথক করে মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া কর্তব্য। এ অবস্থায় অন্য কেউ তার কবুতরের ঝাঁক এবং বকরির পাল ছিনিয়ে নেবে কিংবা তার অনুপস্থিতিতে এগুলোকে ধ্বংস করে দেবে, এ অধিকার তাদের নেই।

বাস্তবতা যদি তা-ই হয়, তবে মাটির দেহ মাটিতেই দাফন করা ন্যায়সঙ্গত। যাতে আগুন, পানি ও বাতাস মাটির দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজ নিজ জায়গায় অবস্থান করতে পারে। কিংবা বায়ুমণ্ডল, পানি ও আগুন নিজ নিজ সমগোত্রীয় পদার্থকে নিজেদের দিকে টেনে নিয়ে আসতে পারে। অর্থাৎ এ মূল উপাদান চতুষ্টয় দুই প্রকার হতে পারে- হয়তো এ চারটি উপাদনই নিজ নিজ উৎসের দিকে ধাবিত হয়। এটাই অধিকাংশ গ্রিক দার্শনিকের মতো। অথবা এদের কেন্দ্রমূল এগুলোকে নিজের মধ্যে টেনে নেয়। এটা পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ধারণা।

মোটকথা, মাটির এই দেহ আপাদমস্তকই মাটি। তাই দেহকে আগুনে না পুড়িয়ে মাটিতে দাফন করাটাই যথাযথ। অবশ্য অর্দ্রতা, ঠান্ডাভাব ও উষ্ণতার কারণে বোঝা যায়, এতে পানি, বাতাস ও আগুনের কিছু অংশ এসে মিলিত হয়েছে। মাটি কোনো উপাদানকে চুরি করে আনেনি। তাই লাশ মাটিতে দাফন করা হলে মাটি তার গঠন-বিন্যাসকে বিচ্ছিন্ন করে প্রত্যেকটিতে আলাদা করে দেবে। ফলে সেগুলোর প্রত্যেক অংশ আপন স্থানে চলে যাবে। অথবা এদের কেন্দ্রস্থল মাটি এগুলোকে নিজের মধ্যে টেনে নেবে। পক্ষান্তরে একে আগুনে সোপর্দ করা হলে সবগুলোকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে।

স্বজনদের সম্প্রীতি ও ভালোবাসা একটি প্রকাশ্য বিষয়। চিন্তা করলে দেখা যায়, অন্যান্য জীব ও প্রাণীর তুলনায় বনি আদমেরই পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধন অধিক মজবুত। আর এমনটি হওয়াই স্বভাবিক। কারণ, সমস্ত আদম সন্তান একই পিতা-মাতার সন্তান। এই সম্প্রীতি ও ভালোবাসার দাবি হলো একে অপরকে দেখভাল করা। জীবিত মানুষের দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে তো কথা নেই। মৃত্যুর পরও মৃতকে আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে রাখতে কারও মন চায় না। এ জন্যই মৃত্যুর সময় তারা কান্নাকাটি করে। লাশ কবরে নিয়ে যাওয়ার সময় তো কান্নায় ভেঙে পড়ে। কিন্তু একান্ত বাধ্য হয়ে লাশ রেখে দিতে না পারলেও ভালোবাসার দাবি কি এটাই যে লাশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে? কক্ষনোই না। ভালোবাসার দাবিদার কারো পক্ষেই এমনটি করা সম্ভব নয়। বরং যথাসম্ভব বাহ্যিক অপবিত্রতা থেকে পাক-পবিত্র করে উত্তম পোশাকে সুসজ্জিত করে সসম্মানে একে কবরস্থ করে এর সংরক্ষণ করা যেতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি ভালোবাসার বাঁধনে আবদ্ধ নয়, সে কী করে তা বুঝবে? প্রেমহীন হিংস্র পাষা- লোকরা এর কী মূল্যায়ন করবে? নির্বোধ আশেকরা এর বাস্তবতা কীভাবে উপলব্ধি করবে?

মৃতকে গোসল দেওয়ার হিকমত : মৃতকে গোসল দেওয়ার হেকতম হলো, গোসলের কাজটিকে জীবিত অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যায়। কেননা, মৃত ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় যেভাবে গোসল করতেন, আজ গোসল দাতাগণও ঠিক সেভাবেই তাকে গোসল দিচ্ছেন। তাই মৃতের সম্মানার্থে বরই পাতা মেশানো পানিতে তাকে গোসল দেওয়া হয়। এর চেয়ে সুন্দর পন্থা আর তী হতে পারে। কারণ, অসুস্থ অবস্থায় বেশির ভাগ সময় শরীরে ময়লা জমে থাকার ফলে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। আর ডানদিক থেকে গোসল শুরু করার নির্দেশ প্রদানের কারণ হলো, মৃতের গোসল যেন জীবিতের মতো হয় এবং এই অঙ্গসমূহের মর্যাদাও সকলের জানা হয়ে যায়।

মৃত ব্যক্তিকে কর্পূর লাগানোর তাৎপর্য : মৃত ব্যক্তিকে কর্পূর লাগানোর তাৎপর্য হলো-

১। যে বস্তুতে কর্পূর লাগানো হয়, সেটা দ্রুত নষ্ট হয় না।

২। কোনো কষ্টদায়ক প্রাণী কাছে আসে না।

৩। কর্পূরের গন্ধে প্রাকৃতিকভাবে মাটিতে সৃষ্ট কীটপতঙ্গ দূর হয়ে যায়। অবশ্য বদণ্ডআমলের কারণে মৃতকে কবরে দংশন করার জন্য সৃষ্ট সাপ-বিচ্ছু ইত্যাদি না কোনো কিছুকে ভয় করে, না তার থেকে দূরে সরে যায়। বরং সদকা ও দোয়া বাতীত দুনিয়ার কোনো কিছুই এগুলোকে দমন করতে পারে না।

উল্লেখ্য, যে সাতটি অঙ্গের দ্বারা সেজদা করা হয়, সেগুলোতে কর্পূর লাগানো হয়। অঙ্গ সাতটি হলো- কপাল, দুই হাঁটু, দুই পা ও দুই হাত। এ অঙ্গগুলো নির্দিষ্ট হওয়ার কারণ হলো, এসব অঙ্গের মাধ্যমে সেজদা করা হতো। তাই এগুলোর অধিক মর্যাদা প্রদানে এরূপ বিধান দেওয়া হয়েছে।

৪। শরীরের সব কার্যক্রম এসব অঙ্গ দ্বারাই সংঘটিত হয়। এগুলোতে কর্পূর লাগালে সব অঙ্গই যেন এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। (সংগৃহীত)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত