ঢাকা শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/২৯)

বদরুদ্দিন উমরের বদান্যতা

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
বদরুদ্দিন উমরের বদান্যতা

তাবরিজ শাহের ছিল একজন মুহতাসিব। জনগণের ন্যায় অন্যায়, নীতি নৈতিকতার ওপর নজরদারির দায়িত্ব যারা পালন করতেন, আগেকার দিনে তাদের বলা হতো মুহতাসিব। বাংলায় আমরা ন্যায়পাল বলতে পারি। মুহতাসিবের নাম ছিল বদরুদ্দিন উমর। ন্যায়পাল হয়েও তিনি ছিলেন উদার মনের, মানুষের উপকার কল্যাণে নিবেদিত, দানশবীর হিসেবে খ্যাতি ছিল দেশ জুড়ে। অভাবী, অসহায়, ফকির দরবেশের প্রত্যাশার প্রাণকেন্দ্র ছিল তার বাড়ি। আরেক শহরের এক দরবেশের সখ্য ছিল দানবীর বদরুদ্দিন উমরের সঙ্গে। যখনই আসত অকল্পনীয় দয়াদানে ভরে দিত দরবেশকে। এতে বদরুদ্দিনের দানের প্রতি দরবেশের আশা ভরসা দিন দিন বেড়ে যায়। সে আশায় দরবেশ অনেক কর্জ করে বসে। তার ভরসা তাবরিজ যেতে পরলে সব লোন একদিনে শোধ করতে পারবে।

হাম বে পুশতে অন করিম উ ওয়াম কর্দ

কে বে বখশিশহাশ ওয়াসেক বুদ মর্দ

দানবীরের ভরসায় বাড়াল সে ঋণের বোঝা

বদরুদ্দিনের দানের ওপর যে ছিল পূর্ণ আস্থা।

বদরুদ্দিনের একটিবার দানে সব ঋণ মিটে যাবে এই ভরসায় দরবেশ মাথায় নিয়েছিল বেপরোয়া ঋণের বোঝা। ওদিকে ঋণদাতাদের মন উসকুস করছিল নানা সংশয় দুশ্চিন্তায়। এত এত টাকা এই গরিব কীভাবে দেবে, আমাদের টাকাগুলো মারা না যায় পাছে। কিন্তু গরিবের মনে ছিল দান পাওয়ার বুক ভরা আশা। আকাশের মেঘমালার ভারি বরিষণের আস্থা যার মনে সে কি সংকোচবোধ করবে পিপাসার্তদের মাঝে পানি বণ্টনে?

পাওনাদারদের তাগাদায় একদিন দরবেশের মন হঠাৎ কেঁপে উঠে ‘নয় হাজার দীনার ঋণ কীভাবে শোধ করব, আমার কী উপায় হবে।’ এই চিন্তা থেকে সে রওনা হলো, তাবরিজে তার আশার বেহেশতের পানে। তাবরিজের ফুলবনের আশায় দরবেশ যাচ্ছিল বটে; কিন্তু জানত না তার আশার ফুলগুলো মৃয়মান হয়ে ঝড়ে পড়েছে। দরবেশ যতই তাবরিজের নিকটবর্তী হয়, ততই তার মন উচাটন হয়ে উঠে। তাবরিজের নাম আসাতে মওলানার মনও অস্থির হয়ে উঠল, ফুলবন নয় একটি নামের আকর্ষণে। এই তাবরিজের ফুলের বনে পথে প্রান্তরে প্রখর তাপে হৃদয়তীর্থে প্রাণের বন্যা আনে একখানি সূর্য। আরবিতে সেই সূর্যের আরবি নাম শাসম। তাবরিজের শামসের জন্য মওলানার প্রাণ পাগলপারা।

সফরের দুঃখ-কষ্ট, ক্লান্তি শেষে দরবেশ এখন তাবরিজে। বদরুদ্দিন উমরের বাড়ির উদ্দেশ্যে যেতে দেখে লোকেরা বলল, মহান দানবীর গত পরশু চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তিনি ছিলেন আরশের ময়ূর। প্রিয়তমের ডাকে সাড়া দিয়ে আরশের পানে মেলেছিলেন তার পেখম । এ কথা শুনেই লোকটি-

না-রেয়ি জাদ মর্দ ও বিহুশ উফতাদ

গুয়িয়া উ নিজ দর পেই জান বেদাদ

একটি চিৎকার দিল গরিব এখন বেহুশ বেতাব

মনে হয় সেও তার পথে করল প্রাণ ত্যাগ।

হায় আমার কী হবে? আমার ঋণের বোঝা কে লাঘব করবে? আমি কার কাছে আশ্রয় পাব- এ কথা চিন্তা করে বুকফাটা চিৎকার দিয়ে দরবেশ মাটিতে পড়ে গেল, বেহুশ বেতাব। লোকেরা হুড়মুড় করে এগিয়ে এলো তার সেবাযত্নে। তার মুখে মাথায় পানি ঢালে। গোলাব জলের ছিঁটা দিয়ে হুঁশ ফিরানো চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই হুঁশ ফিরে না দরবেশ বেহুঁশ বেতাব। অবশেষে হুঁশ ফিরল সন্ধ্যা নাগাদ। আত্ম উপলব্ধির চেতনায় দরবেশ এখন আরেক জগতে। দরবেশ বুঝতে পারে ভুলটা কোথায় হয়েছে।

চোন বেহুশ আমদ বেগোফত আই কির্দগার

মুজারেমম বুদাম বে খালক উ-মিদওয়ার

হুঁশ ফিরে পেয়ে দরবেশ বলল, প্রভুহে আমি

নিশ্চিত দোষী, সৃষ্টির প্রতি ছিলাম আশাবাদী।

আমার উচিত ছিল তোমার সাহায্যের প্রতি আশাবাদী হওয়া। কিন্তু তোমার পরিবর্তে তোমার সৃষ্টির প্রতিই আমি ভরসা করেছিলাম, মনে করেছিলাম দানবীর খাজা বদরুদ্দিন আমাকে সংকট হতে উদ্ধার করতে পারবে। অথচ-

গরচে খাজা বস সাখাওয়াত কর্দে বুদ

হিচ আন কুফওয়ে আতায়ে তো নবুদ

খাজা যদিও দান-দক্ষিণা করেছিল অপরিমেয়

তোমার দানের সঙ্গে হতে পারে না তুলনীয়।

খাজা আমাকে অনেক সাহায্য করেছিল, দানে দক্ষিণায় আমাকে ভরে দিয়েছিল; কিন্তু তোমার দানের সঙ্গে তার দান মোটেও তুলনীয় নয়।

উ কুলাহ বখশিদ ও তো সার পুর খেরাদ

উ কাবা বখশিদ ও তো বালা ও কাদ

খাজা দিয়েছে টুপি তুমি দিয়েছ জ্ঞানবান মাথা

জামা দিয়েছে খাজা তুমি দিয়েছ জামা পরার কায়া।

উ জারাম দাদ ও তো দস্তে যার শোমার

উ সতুরাম দাদ ও তো আকলে সওয়ার

খাজা স্বর্ণরৌপ্য দিয়েছে তুমি দিয়েছ স্বর্ণ গণনার হাত

ঘোড় দিয়েছে খাজা তুমি বুদ্ধিমত্তা ঘোড়ায় চড়ার ।

খাজা শামআম দাদ ও তো চশমে কারির

খাজা নোকলাম দাদ ও তো তামএ পজির

খাজা জে¦লেছে প্রদীপ তুমি দিয়েছ আলোকিত চোখ

বুদ্ধিমত্তা খাবার দিয়েছে তুমি দিয়েছ পাকস্থলী, পরিপাক।

উ ওজিফে দাদ ও তো উমরো হায়াত

ওয়াদে আশ যর ওয়াদেয়ে তো তাইয়েবাত

খাজা দিয়েছে বেতন-ভাতা তুমি দিয়েছ জীবন হায়াত

ধনের আশায় রেখেছে খাজা তুমি দিয়েছ রিজিক হালাল।

উ ওয়েসাকাম দাদ ও তো চর্খে জমিন

দর ওয়েসাকত উ ও সাদ চোন উ সমিন

খাজা দিয়েছে বসতবাড়ি তুমি দিয়েছ আকাশ, জমিন

তোমার বসতবাড়িতে সেও আশ্রিত, অগণিত প্রাণী।

জার আজ আনে তোস্ত জার উ নাফরিদ

নান আজ আনে তোস্ত নান আজ তোশ রসিদ

স্বর্ণরৌপ্য তোমারই সৃষ্টি, খাজা সৃষ্টি করেনি সোনাদানা

রুটিরুজি তোমারই দান সেও ভোগ করে তোমার অনুদান।

আয সাখা ও রাহম হাম তো দাদি আশ

কায সাখাওয়াত মি ফুজুদি শাদি আশ

তার যে দান বদান্যতা তুমিই দিয়েছ তাকে চেতনা

দান দক্ষিণা করলে তুমিই দিয়েছ তার মনে প্রফুল্লতা।

মন মর উ রা কেবলায়ে খোদ সাখতাম

কেবলা সাজে আসল রা আন্দাখতম

আমি ভুলে খাজাকে গণ্য করেছি আমার কেবলারূপে

ভুলে গিয়েছিলাম স সত্য তুমিই যে আমার কেবলা হবে।

সত্যিই বিচার দিনের মালিক যেদিন আমাদের পানি ও মাটির কায়ায় আকল জ্ঞানবুদ্ধির চারাগাছ রোপণ করেন সেদিন আমরা কোথায় ছিলাম। যখন এই জমিনকে বিস্তৃত প্রসারিত করেন, আসমানকে বিশাল শামিয়ানা বানান, আসমানের বুকে গ্রহতারার চেরাগ জ্বালান, চার উপাদানের সমন্বয়ে বস্তুজগতকে সাজান, তাতে কী আমাদের ভূমিকা ছিল? আমাদের অস্তিত্ব তখন কোথায় ছিল? তিনিই তো সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সকলকিছুর মালিক।

মওলানা এখানে আরও একটি হাকিকত প্রকাশ করতে চান। তাহলো, তোমার সঙ্গে যে শত্রুতা করছে, তোমার প্রতি অন্যায় অপরাধ করছে তা সেই অন্যায় অপরাধের প্রতিফলন, যা তোমার মধ্যে আছে।

ওয়ান গুনাহ দর ওয়েই জে জিনসে জোর্মে তুস্ত

বায়দ আন খু রা যে তাবএ খেশ শুস্ত

যে দোষ দেখ তার মাঝে তোমারই দোষের অংশ মূলে

অবশ্যই সে স্বভাব ধুয়ে ফেলা চাই তোমার চরিত্র হতে ।

আল্লাহর প্রতি বা আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি তুমি যে দোষ অপরাধ করেছ সেটিই তোমার দিকে ফিরে আসে তোমার শত্রুর পক্ষ হতে দোষ অপরাধরূপে। কাজেই তুমি আগে তোমার মনের জমিনকে আগাছামুক্ত কর, অন্যের প্রতি শত্রুতার শিকড় উৎপাটিত কর, তখন সবাইকে নিজের বন্ধু হিসেবে দেখতে পাবে। মওলানা আরও বুঝিয়ে বলেন, মানুষ মানুষের আয়না। কাজেই অন্যের মধ্যে যা দেখ, তা আয়নায় তোমারই প্রতিচ্ছবি।

মওলানার চিন্তা আবার ঊর্ধ্বজগতে চলে গেল। তিনি বুঝিয়ে বলেন, তোমার উদাহরণ সেই লোকের মতো যে পানির মধ্যে তারার প্রতিচ্ছবি দেখে মনে করে, এই তারাই আমার অশুভ অলক্ষণের কারণ। মাটি ফেলে তারাটি ঢেকে বা ভরাট করে দেয়ার চেষ্টা করে। কারণ, তার ধারণায় পানিতে প্রতিফলিত তারা আসল তারা। আকাশের তারার ছবি নয় তা। এক পর্যায়ে যখন তারার ছবিটি পানি থেকে সরে যায় তখন ভাবে, আমার অলুক্ষণে তারা গায়েব হয়ে গেছে পানির মাঝ থেকে। কিন্তু আহমক বুঝতে পারে না, পানিতে তারা থাকে না, তারা থাকে আকাশে। সেই তারাই প্রতিফলিত হয় জমিনে। কাজেই এই পৃথিবীতে শুভ অশুভ যাই ঘটে তা আসে উর্ধ্বজগত হতে। কাজেই মন্দ অশুভের হাত হতে নিস্তার পেতে সেদিকেই যেতে হবে।

মওলানা বলেন যে, এই পৃথিবীতে বা তোমার দুশমনের মধ্যে যে শত্রুতা, প্রকৃতার্থে তা আল্লাহর কাহহারিয়্যত, তিনি দমনকারী ও কঠোর- এই গুণবাচক নামের প্রতিফলন। কারণ, সমগ্র জগত আল্লাহর নামগুলো ও গুণসমূহের উদ্ভাস। কাজেই শত্রুর হাত থেকে, যেকোনো অশুভ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে তোমাকে আশ্রয় নিতে হবে আসলের কাছে। তিনিই পরীক্ষা হেতু বা সৃষ্টি-ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনে জীবন জগতের নানা পরতে তার নামের ও গুণের বিচিত্র প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। বলতে হবে ‘একমাত্র আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।’ মওলানা বুঝিয়ে বলেন-

দাদ দাদে হক শেনাস ও বখশিশাশ

আকসে আন দাদ আস্ত আন্দর পাঞ্জ শাশ

দান, আল্লাহরই দান জান যত দয়া অনুগ্রহ

তারই দানের প্রতিচ্ছবি পাঁচ-ছয়ে প্রতিফলিত।

পাঁচ বলতে মানুষকে দেওয়া পঞ্চেন্দ্রিয় আর ছয় মানে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম, উর্ধ্ব অধঃ ছয়দিকের বস্তুজগত। জীবন ও জগতে যত মায়া-মমতা, দান-অনুগ্রহ দেখ তা আল্লাহর ওয়াহহাব গুণবাচক নামের প্রতিফলন। কাজেই তুমি তার কাছে যাও, যার দয়াদান অগণিত অবারিত, সর্বত্র বিরাজিত। দানবান হয়তো বিরাট অঙ্কে দানে তোমাকে ভরে দেবেন; কিন্তু আল্লাহ যখন দেবেন দানের সাথে তা ভোগ করার জন্য হায়াতও বাড়িয়ে দেবেন, যা অন্য কারও কাছ থেকে আশা করা যায় না। আল্লাহর দান তোমার জীবনে এমনভাবে মিশে যাবে যেভাবে তার দেওয়া প্রাণ মিশে আছে তোমার অস্তিত্বে।

দাদে হক বা তু দর আমিজদ চো জান

আনচুনানকে আন তু বাশি ও তো আন

আল্লাহর দান তোমার সঙ্গে মিশে যাবে এমনভাবে

দান যেন তুমি আর তুমি পরিণত হবে স্বয়ং দানে।

দাতা, দান আর দানগ্রহণকারী তখন একাকার হয়ে যাবে। তখন তোমার মধ্যে তার প্রেমের উজ্জীবন হবে। বস্তুগত জীবনের চেয়ে আধ্যাত্মিক জীবন তখন তোমার কাছে অধিক মূল্যবান হবে। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ৩০২৯-৩১৭১)। (ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত