ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাঁকখালী নদীর তীর উচ্ছেদ জনতার বাঁধায় পণ্ড

হামলার ঘটনায় ২৫০ জনের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা
বাঁকখালী নদীর তীর উচ্ছেদ জনতার বাঁধায় পণ্ড

কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর তীরে উচ্ছেদ অভিযানের তৃতীয় দিন বুধবার জনতার বাঁধার মুখে পণ্ড হয়ে গেছে। দিনভর উচ্ছেদ আতংকে থাকা লোকজনের বিক্ষোভ ও প্রতিবন্ধতার পর বিকাল ৪টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেয়া হয় উচ্ছেদ অভিযানের জন্য আনা বুলডোজার। একই সঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে দেখা গেছে।

বুধবার সকালে কস্তুরাঘাটের পূর্ব পাশের পেশকার পাড়ার অংশে উচ্ছেদ শুরু করতে গেলে সেখানে বসবাসরত জনতা সড়ক অবরোধ করে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। অভিযান দল পেছনে এসে নদীর অংশ থেকে অভিযান শুরু করার চেষ্টা করলেও সেখানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়।

শত-শত জনতা উভয় পাশে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে। তারা বলছেন, এসব জায়গার বৈধ কাগজ ও খতিয়ান রয়েছে। তারা প্রাণ দিবেন তবে উচ্ছেদ অভিযান করতে দেবেন না। ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক পুলিশ, র‌্যাব ও সেনা বাহিনীর সদস্যের উপস্থিতিতে নির্বাহী ম্যাজিষ্টেট জনতাকে সরে যাওয়ার জন্য বার বার আহবান জানালেও তাদের সরানো যায়নি।

বিআইডব্লিউটিএ এর পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন জানান, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তৃতীয় দিন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা সম্ভব হয়নি। এব্যাপারে জেলা প্রশাসক সহ সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক করে পরবর্তি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

মঙ্গলবার হামলার ঘটনায় এজাহারনামীয় ৯ জন সহ ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা:

মঙ্গলবার কস্তুরাঘাটস্থ বাঁকখালী নদীর তীরে অবৈধভাবে দখল করে তৈরি স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানের সময় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় এজাহারনামীয় ৯ জন সহ ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এঘটনায় চারজনকে আটক করা হয়েছে।

বুধবার কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

মঙ্গলবার সকাল ১১ টার দিকে কক্সবাজার শহরের কস্তুরাঘাট-খুরুশকূল সংযোগ ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় অভিযান শুরু করতে গেলে দখলদাররা বাঁধা প্রদান করা। এসময় ছোঁড়া ইটের আঘাতে পুলিশের এক সদস্য আহত হওয়ার তথ্য জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইলিয়াস খান।

আহত পুলিশ কনেস্টেবল করিমকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ওসি ইলিয়াস খান বলেন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ ( বিআইডব্লিটিএ ) কর্তৃপক্ষ সোমবার থেকে কস্তুরাঘাট সংলগ্ন বাঁকখালী নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে উঠা স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। প্রথমদিনে বেশ কিছু স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে দ্বিতীয়দিনের উচ্ছেদ শুরু করে। অভিযানে বিআইডব্লিউটিএ এর কর্মিদের পাশাপাশি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র‌্যাব সেনাবাহিনীর সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। সকাল ১১ টার দিকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করতে গেলে অবৈধ দখলদারের লোকজন বাঁধা দেন। এসময় পুলিশসহ আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে দখলদারের একটি অংশ পিছন থেকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে পুলিশের এক সদস্য ইটের আঘাতে মাথা ফেটে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঘটনার সময় হামলাকারিদের ধাওয়া দিয়ে পুলিশ ৪ জনকে আটক করে বলে জানান ওসি।

এব্যাপারে দায়ের করা মামলায় ৪ জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারের পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

কক্সবাজার শহরের প্রাণ কেন্দ্র কস্তুরাঘাটস্থ সোমবার শুরু হয় বাঁকখালী নদীর তীরে অবৈধভাবে দখল করে তৈরি স্থাপনা উচ্ছেদের অভিযান। দুই দিনে অন্তত যেখানে ৭০ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। দ্বিতীয় দিন অভিযানের শুরুতে অবৈধ দখলদারদের ছোঁড়া ইটের আঘাতে পুলিশের এক সদস্য আহত হয়েছে। এসময় ৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ সূত্র জানিয়েছে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে উৎপত্তি হয়ে ৮১ কিলোমিটারের বাঁকখালী নদীটি রামু ও কক্সবাজার সদর হয়ে শহরের কস্তুরাঘাট-নুনিয়াছটা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। নুনিয়ারছড়া থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত ছয় কিলোমিটারে সবচেয়ে বেশি দখলের ঘটনা ঘটেছে। গত ১০ থেকে ১২ বছরে এই ছয় কিলোমিটারে ১ হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় ভূমি অফিস এবং বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে বাঁকখালী নদীর অবৈধ দখলদারদের পৃথক তালিকা তৈরি করেছে । সহস্রাধিক অবৈধ দখলদার থাকলেও দুই তালিকায় স্থান পেয়েছে প্রায় সাড়ে ৩০০ জন প্রভাবশালী।

বিআইডব্লিউটিএ-এর সূত্র মতে, ২০১০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার বিআইডব্লিউটিএকে বাঁকখালী নদীবন্দরের সংরক্ষক নিযুক্ত করে। প্রজ্ঞাপনে নদী তীরের ৭২১ একর জমি বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। জমি বুঝিয়ে দিতে বারবার জেলা প্রশাসনকে জানানো হলেও তারা তা দেয়নি। ফলে নদীবন্দর প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় দখল অব্যাহত ছিল।

যার সূত্র ধরে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ যৌথ অভিযান চালিয়ে ৬ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জেলা প্রশাসন। তখন দখলমুক্ত করা হয় বাঁকখালী নদীর ৩০০ একরের বেশি প্যারাবনের জমি। কিন্তু পরে তা আবারও দখল হয়ে যায়। উচ্ছেদ করা প্যারাভূমিতে ফের নির্মিত হয়েছে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি, দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা।

এর মধ্যে বাঁকখালী নদীর সীমানায় থাকা সব দখলদারের তালিকা তৈরি করে আগামী চার মাসের মধ্যে উচ্ছেদ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে গত ২৪ আগস্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

মামলার রায়ে বলা হয়, কক্সবাজারে বাঁকখালী নদীর বর্তমান প্রবাহ এবং আরএস জরিপের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণপূর্বক নদীটিকে সংরক্ষণ করতে হবে। এ ছাড়া নদীর সীমানায় থাকা সব দখলদারের তালিকা তৈরি করে আগামী চার মাসের মধ্যে উচ্ছেদ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

যার সূত্র ধরে শনিবার কক্সবাজার সফরে আসেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি কক্সবাজার হিলটপ সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে 'হাইকোর্টের আদেশ মোতাবেক বাঁকখালী নদী দুষণ ও দখলমুক্তকরণের লক্ষ্যে বিশেষ সমন্বয় সভা'য় প্রধান অতিথি ছিলেন। সভা শেষে তিনি কথা বলেন সাংবাদিকদের সাথে।

এসময় তিনি কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর দখলদারদের সমন্বিত তালিকা করে উচ্ছেদ করা হবে বলে জানিয়েছেন। যার সূত্র ধরেই সোমবার শুরু হয়েছে উচ্ছেদ অভিযান।

বাঁকখালী নদী,উচ্ছেদ,জনতা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত