
নামমাত্র শ্রমে ও অল্প খরচে অধিক লাভ হওয়ায় শেরপুরের নকলা উপজেলার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে পানিফলের চাষ। ফলটি সুস্বাদু হওয়ায় এর জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। সুস্বাদু এ ফলটি বাজারজাত করাও সহজ। পানি নিষ্কাশিত না হওয়া জলাবদ্ধ এলাকায় অন্য কোনো আবাদ করা সম্ভব নয়। এমন পতিত জমিতে খুব সহজেই পানিফল চাষ করা যায়।
অল্প খরচে উৎপাদন বেশি এবং বেচাবিক্রি লাভজনক হওয়ায় পানিফল চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। জলাবদ্ধ জমিতেই এই ফলের চাষ হয়, ভোগান্তি কম কিন্তু ফলন বেশি পাওয়া যায়। অন্য ফসলের তুলনায় পানিফল চাষে কয়েকগুণ লাভ পাচ্ছেন চাষীরা। এতে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে এই ফল চাষে আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
গত দুই দশক ধরে নকলার চরাঞ্চলের গ্রামের কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে পানিফল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া অনেক প্রান্তিক কৃষকের সংসারে ফিরেছে স্বচ্ছলতা।
চাষিরা জানান, পানিফল মানুষের কাছে অতি পরিচিত। এটি স্থানীয়দের কাছে পানিসিংড়া নামে পরিচিত। জলাবদ্ধ পতিত জমিতে এই ফলের চাষ হয়। পাতার গোড়া থেকে শিকড়ের মতো বের হয়ে বংশ বিস্তার করে এবং শিকড় থেকে ফল ধারণ করে। এ ফল চাষে বেশি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। সার ও কীটনাশকের পরিমাণও কম লাগে। মূলত বর্ষা মৌসুমেই পানিফল চাষ হয়।
এখন শুধু গ্রামে নয়, শহরের বাজারেও পানিফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভাদ্র থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত জলাবদ্ধ জমিতে চারা রোপণ করা হয়। অগ্রহায়ণ থেকে পৌষ মাসের শেষ পর্যন্ত উৎপাদন হয়। চাষিরা জানান, এ ফল চাষের জন্য ডোবা, বদ্ধ জলাশয় বা মাছের ঘেরের সুবিধাজনক স্থান ব্যবহার করা হয়। সামান্য লবণাক্ত ও মিষ্টি পানিতেও চাষ করা যায়। পানিফল গাছ কচুরিপানার মতো পানির উপরে ভেসে থাকে। এর শিকড় পানির নিচে থাকে এবং পাতা পানির উপরে ভাসে। কচি অবস্থায় লাল, পরে সবুজ এবং পরিপক্ক হলে কালো রঙ ধারণ করে।
নকলায় পানিফলের বাণিজ্যিক চাষ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। বদ্ধ জলাশয় ও খাল-বিলে এ ফল উৎপন্ন হয়। ফলটির পুরু খোসা ছাড়ালেই পাওয়া যায় হৃৎপিন্ডাকার বা ত্রিভুজাকৃতির নরম সাদা শাঁস। কাঁচা ফলের এই নরম শাঁস খেতে বেশ সুস্বাদু।
বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, উপজেলার পাঠাকাটা, চরঅষ্টধর, চন্দ্রকোনা, উরফা, গণপদ্দী ও বানেশ্বরদী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে পানিফল চাষ করা হয়েছে। পাঠাকাটা ইউনিয়নের কৈয়াকুড়ি, পলশকান্দি, দশকাহনিয়া, তাতড়াকান্দা ও নামা কৈয়াকুড়ি এলাকায় বেশি চাষ হয়েছে। চরঅষ্টধর, চন্দ্রকোনা, উরফা, গণপদ্দী ও বানেশ্বরদী ইউনিয়নের বদ্ধ জলাশয় ও পুকুরেও চাষ করা হয়েছে।
নামা কৈয়াকুড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন চাষী তাদের জমি থেকে পানিফল সংগ্রহ করছেন। প্রতি বছর এই গ্রামে ১০–১৫ জন কৃষক চাষ করেন। তাদের মধ্যে খোকন মিয়া ৩০ শতাংশ জমিতে, ইসলাম মিয়া ২৫ শতাংশ, আবুল হোসেন ৪০ শতাংশ, আনারুল ইসলাম ২০ শতাংশ, শাখাওয়াত হোসেন ২৫ শতাংশ এবং আমির উদ্দিন ২০ শতাংশসহ অনেকে নিচু জমিতে পানিফল চাষ করেছেন।
চাষী খোকন মিয়া জানান, পতিত পুকুর-ডোবা বা নালায় বর্ষাকালে অল্প পানি থাকলে এমন নীচু জমিতে চাষ ভালো হয়। অল্প খরচে লাভ বেশি পাওয়া যায়। তবে প্রতিদিনই জমি থেকে ফল সংগ্রহ করতে হয়। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে বীজ বা কাটিং করা গাছ রোপণ করা হয়। তিন মাস পরে উৎপাদন শুরু হয়। ৩–৪ মাসিক এ ফল গাছ থেকে ৫–৬ বার ফল তুলা যায়। পানি বেশি হলে ফলন তত ভালো হয়।
নামা কৈয়াকুড়ি এলাকার স্থানীয় বুলবল আহমেদ জানান, এই ফল চাষের ফলে নিচু পতিত জমি ও বদ্ধ জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে। এতে নতুন মৌসুমি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক প্রান্তিক চাষী অন্যের জমি বা চুক্তিভিত্তিকভাবে জমি নিয়ে পানিফল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। মাছ ও পানিফল বিক্রি করেই এলাকার অনেকে জীবিকা নির্বাহ করেন। খাল-বিলের তীরে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী বাজার।
এক বিঘা জমিতে পানিফল চাষ করে গড়ে লাভ থাকে ১৫–২০ হাজার টাকা। কৃষিবিভাগের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহজ শর্তে কৃষি ঋণ পেলে দেশের জলাবদ্ধ অনাবাদী ভূমিতে পানিফল চাষের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে।
খন্দকার দাওয়াখানার স্বত্বাধিকারী হাকিম খন্দকার জসিম উদ্দিন জানান, পানিফলে পুষ্টিমানের পাশাপাশি ঔষধি গুণ রয়েছে। এটি এলার্জি ও হাত-পা ফোলা রোগের উপশমকারী একপ্রকার ভেষজফল। এছাড়া তলপেটের ব্যথা, পিত্তপ্রদাহ, উদর ব্যথা ও ক্ষতিকর পোকার কামড়ে এর শাঁস প্রলেপ উপকারী।
পাইকারি বিক্রেতা বাজু মিয়া, কাদীর, হানী ও মোতালেবসহ উপজেলায় ৩০–৩৫ জন পাইকার এবং ৮০–৯০ জন খুচরা বিক্রেতা রয়েছেন। উপজেলার বিভিন্ন বাজারে এই ফল বিক্রি করে বছরের ৩–৪ মাসের সংসার চলে। এবছর উপজেলায় প্রায় শত একর জমিতে পানিফল চাষ হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী জানান, পানিফল রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মুক্ত হওয়ায় নিরাপদ। জলাবদ্ধ জমিতে যেখানে ধান বা অন্যান্য ফসল আবাদ সম্ভব নয়, সেসব জমিতে চাষ করে প্রান্তিক কৃষকরা স্বাবলম্বী হতে পারেন। তিনি বলেন, আগামীতে উপজেলার জলাবদ্ধ পতিত জমিতে পানিফল চাষ করে যেকেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন।