ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পাবনায় পোকা চাষ করে স্বাবলম্বী যুবক শিমুল

পাবনায় পোকা চাষ করে স্বাবলম্বী যুবক শিমুল

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য—কালো পোকা (ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই) চাষ করে নিজের ভাগ্য বদলে ফেলেছেন পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার পারসিধাই গ্রামের যুবক শিমুল হোসেন। এক সময়ে যে ছিল সবার কাছে অবহেলার পাত্র, সে এখন সমাজের সবার আইডল। পোকা চাষ করে মাত্র চার বছরে পরিশোধ করেছেন ১৬ লাখ টাকার ঋণ।

নিজ এলাকায় এবং কক্সবাজারে গড়ে তুলেছেন আরও দুটি নতুন খামার। সব খরচ বাদে এখন তার মাসিক আয় অন্তত দেড় থেকে ২ লাখ টাকা। শিমুলের মতো আরও অনেক উদ্যোক্তা এখন পোকা চাষ করে জীবন-সংসারের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন।

কালো পোকা বা ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই দেখতে মাছির মতো। এটি মূলত মাছি-জাতীয় প্রাণীর লার্ভা, আকারে কিছুটা লম্বা। ময়লা-আবর্জনা, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ও হোটেলের খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ—এই দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনাই ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ের খাবার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাছ ও পোলট্রির প্রচলিত খাদ্যের বিকল্প হতে পারে এই ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই, কারণ এর পুষ্টিমান বেশি এবং খরচ তুলনামূলকভাবে কম। পাশাপাশি এটি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শিমুল জানান, এক সময় অর্থের অভাবে তিনি হতাশায় ভুগছিলেন। ফ্যাশন ডিজাইনে ডিপ্লোমা শেষ করে ঢাকায় চাকরি করতেন, কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারেননি। কৃষিতে কিছু করার ইচ্ছা থেকেই চাকরি ছেড়ে ২০১৮ সালে বাড়ি ফিরে হাঁস পালন শুরু করেন। নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি ১৮ লাখ টাকার ঋণের বোঝা নেন। পরে ইউটিউবে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই চাষের ভিডিও দেখে আগ্রহী হয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নেন এবং বাজার ব্যবস্থার খোঁজখবর নেন। এরপর শুরু করেন এই পোকা চাষের পরিকল্পনা।

পাবনার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা “প্রোগ্রাম ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (পিসিডি)” বাস্তবায়িত ‘রুরাল মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট’ থেকে ঋণ ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। পিসিডি তাকে মার্কেট চেইন ও প্রযুক্তিগত সহায়তাও দেয়। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ান শিমুল। প্রথমে তিনি ৩০০ কেজি লার্ভা উৎপাদন করেন (বাজার মূল্য ৮০ টাকা কেজি হিসেবে ৭২ হাজার টাকা)। এগুলো স্থানীয় বাজার ও ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। এভাবে ধীরে ধীরে তিনি কক্সবাজারে প্রায় ৩০ লাখ টাকায় বড় আকারের ফার্ম স্থাপন করেছেন।

তরুণ উদ্যোক্তা শিমুল বলেন, “পোকা চাষের কারণে স্থানীয়রা এক সময় আমাকে পাগল ভাবত। কিন্তু কিছুদিন আগে আমি ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানে মাদার পোকা (পিউপা) রপ্তানি করেছি। উদ্যোক্তারা ওই দেশগুলোতেও এই পোকার খামার করছেন।”

পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীপক কুমার পাল জানান, প্রচলিত বাজারে মাছ ও পোলট্রির খাবারের প্যাকেটে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ প্রোটিন থাকে, কিন্তু ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ে প্রোটিনের পরিমাণ ৪৩ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত। এ কারণে মাছ ও পোলট্রির খাবার হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে এই পোকা। এর উৎপাদন খরচও কম—এক কেজি পোকার উৎপাদন খরচ ১০ থেকে ১২ টাকা, যা বিক্রি হয় সময়ভেদে ৫০ থেকে ৮০ টাকায়।

পিসিডি নির্বাহী পরিচালক মো. শফিকুল আলম বলেন, “আমাদের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা পেয়ে শিমুল এখন দেশের সেরা ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই উৎপাদনকারী। এমন অসংখ্য উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছি আমরা। তাদের হাত ধরে আগামীর গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।”

চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়, ব্ল্যাক সোলজারের শক্ত খোলসযুক্ত মূল পোকাগুলো একটি জালের মধ্যে, দিনের বেলায় আলো-বাতাস আসে এমন জায়গায় রাখা হয়। পোকাগুলো প্রজনন শেষে কাঠের স্তরের মধ্যে ডিম পাড়ে। সেই ডিমগুলো হ্যাচিং করে ফোটানোর আট থেকে ১০ দিন পর আলাদা স্থানে রাখা হয়, সেখান থেকে তৈরি হয় লার্ভা। ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এই লার্ভাগুলো দেখতে পোকার মতো হয়, যা মাছ, হাঁস বা মুরগির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ২০ থেকে ৩০ দিন পর লার্ভাটি থেকে গেলে তা মাছিতে পরিণত হয়। একেকটি প্রাপ্তবয়স্ক মাছির জীবনকাল ৮ থেকে ১০ দিন এবং প্রত্যেকটি মাছি ৯০০ থেকে ১ হাজার পিউপা উৎপাদন করে মারা যায়।

মুরগির নাড়িভুড়ি, পচা বা নষ্ট মাছ এবং বিভিন্ন বর্জ্য লার্ভার খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই পোকা ফিশারিজ ও পোলট্রি শিল্পের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ব্যাপক প্রোটিনসমৃদ্ধ এই খাবার খাওয়ালে কম খরচে মাছ ও পোলট্রির উৎপাদন বাড়বে। এর মাধ্যমে বায়োটেকনোলজি, সার এবং মানসম্মত প্রোটিন পাওয়া সম্ভব। এই পোকা পরিবেশবান্ধবও।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাইয়ের বৈশ্বিক বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার হবে ৩৪ শতাংশেরও বেশি। মাছ ও পোলট্রি ফিডের বর্তমান বাজার প্রায় ৯৮৬ কোটি টাকার ওপরে। পোলট্রি, মাছ ও পশুপালন বাড়ার কারণে গত এক দশকে ফিড শিল্প বেড়েছে অন্তত ২৫ শতাংশ।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে হাঁস-মুরগির খামার আছে প্রায় ৬০ হাজার। মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে মুরগি ও মাছের খামার। বর্তমানে ২৫ জেলায় ২৮০ জনের বেশি উদ্যোক্তা বাণিজ্যিকভাবে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই চাষ করছেন। মাসে তারা প্রায় ৭০ টনেরও বেশি পোকা উৎপাদন করেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এই খাতে উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা।

স্বাবলম্বী যুবক শিমুল,পাবনায় পোকা চাষ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত