
চব্বিশের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দেওয়া মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরকে আজও তৃতীয় দিনের মতো জেরা করবেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তিনি এই জেরা করছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে।
বুধবার (৮ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলের সামনে এ জেরা অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে, গতকাল মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের মতো জেরা সম্পন্ন করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত এই আইনজীবী। জুলাই গণহত্যা নিয়ে সাক্ষীর দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে তিনি তাঁর মক্কেলদের পক্ষে বিভিন্ন সাফাই প্রশ্ন তুলে ধরেন। আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে যুক্তি খণ্ডন করেন তিনি। দিনভর জেরা চললেও তা শেষ না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আজ (বুধবার) পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করে।
প্রসিকিউশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এমএইচ তামিম। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার পালোয়ান, তারেক আবদুল্লাহ, মামুনুর রশীদসহ অন্যরা।
এর আগে, গত ৬ অক্টোবর থেকে জেরা শুরু হয়। তারও আগে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর মামলার তৃতীয় দিনের মতো সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর, যিনি এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ৫৪তম এবং সর্বশেষ সাক্ষী। জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেন, গত বছরের জুলাইয়ের আন্দোলনের সময় ৪১টি জেলার ৪৩৮টি স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় এবং ৫০টিরও বেশি জেলায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
২৯ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দিনের মতো সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর। ওই দিন তিনি নিজের জব্দ করা তথ্যের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের নৃশংসতা নিয়ে যমুনা টেলিভিশনের একটি প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন। একই সঙ্গে ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের ‘হত্যাযজ্ঞের’ ভয়াবহ চিত্রও তুলে ধরেন তিনি। জবানবন্দিতে তিনি জানান, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর প্রায় তিন লাখ পাঁচ হাজার গুলি ছোড়া হয়েছিল।
তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এ ছাড়া বিবিসি, আল-জাজিরা ও ‘আমার দেশ’-এ প্রচারিত প্রামাণ্যচিত্রও ট্রাইব্যুনালে দেখানো হয়।
২৮ সেপ্টেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরের জবানবন্দি শুরু হয়। ওই দিন তিনি জব্দ করা ১৭টি ভিডিও ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন, যেখানে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঘটনার নির্মমতা ফুটে ওঠে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা এই মামলায় এখন পর্যন্ত ২৫ কার্যদিবসে মোট ৫৪ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। শেষ সাক্ষীর জেরা শেষ হলে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন এবং পরে রায় ঘোষণার দিকে এগোবে বিচারিক কার্যক্রম।
২৪ সেপ্টেম্বর মামলার ২২তম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়। ওই দিন বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা সাক্ষ্য দেন, এরপর তাঁকে জেরা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।
মামলার অন্যতম আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ৩৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। নিজে দায় স্বীকার করে তিনি আগেই রাজসাক্ষী হয়েছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সাক্ষীদের জবানবন্দিতে গত বছরের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে দেশজুড়ে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। শহীদ পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা এ ঘটনাগুলোর জন্য শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
গত ১০ জুলাই ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র মোট আট হাজার সাতশত সাতচল্লিশ (৮,৭৪৭) পৃষ্ঠার, যার মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার আঠারো (২,০১৮) পৃষ্ঠা, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ (৪,০০৫) পৃষ্ঠা এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার সাতশত চব্বিশ (২,৭২৪) পৃষ্ঠার। মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে।
গত ১২ মে তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা চিফ প্রসিকিউটরের কাছে মামলার প্রতিবেদন জমা দেন।