
বর্তমানে চাঁদাবাজি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া এক ভয়ানক ব্যাধি; যা কেবল আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তার ভিত্তিমূলকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। ইসলামে এ জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর বিধান রয়েছে। সামাজিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম কারণ এ চাঁদাবাজি। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি ও ফৌজদারি অপরাধ। যা নৈতিকতা, ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ব্যক্তিগত ক্ষতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অরাজকতা ও দুর্নীতি- সবকিছুর নেপথ্যে চাঁদাবাজির প্রভাব স্পষ্ট। দুঃখজনক হলেও সত্য, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ভয়ভীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ হাতিয়ে নেওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন, বাসস্ট্যান্ড, টেম্পুস্ট্যান্ড, নির্মাণ খাত- সবখানেই চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব। দেশীয় আইনে চাঁদাবাজি একটি ফৌজদারি অপরাধ। এছাড়া পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে ইসলাম অন্যায়ভাবে কারও সম্পদ গ্রহণকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। এর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে চাঁদাবাজির মতো অন্যায় ও জুলুমের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তির বিধান।
চাঁদাবাজির সংজ্ঞা ও প্রকৃতি : চাঁদাবাজি বলতে বোঝায়, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক জোরপূর্বক, ভয়ভীতি দেখিয়ে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে কিংবা অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে অন্যায়ভাবে অন্যের কাছ থেকে অর্থ বা অন্য কোনো সুবিধা আদায় করা। এটি সরাসরি একটি জুলুম ও অপরাধ। চাঁদাবাজি অনেক সময় ব্যক্তি পর্যায়ে, আবার কখনও কখনও রাষ্ট্র বা প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত অংশের মাধ্যমেও সংঘটিত হয়ে থাকে। চাঁদাবাজি গর্হিত অপরাধ। প্রভাবশালী চক্র জোরপূর্বক কাউকে নিজ কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য অথবা নির্দিষ্ট স্থান অতিক্রম করা ইত্যাদির জন্য নির্দিষ্ট অথবা অনির্দিষ্ট পরিমাণে চাঁদা দিতে বাধ্য করাকে সাধারণত চাঁদাবাজি বলা হয়। ডাকাতি ও দস্যুতার সঙ্গে এর মিল আছে। ইসলামের দৃষ্টিতে চাঁদাবাজি হারাম ও কবিরা গোনাহ। চাঁদা উত্তোলনকারী, চাঁদা লেখক ও চাঁদা গ্রহণকারী সবাই ওই গোনাহের সমান অংশীদার। কারও কাছ থেকে জোর করে টাকা নেওয়া হারাম।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না। এ উদ্দেশে বিচারকের কাছে এমন কোনো মামলা করো না যে, মানুষের সম্পদ থেকে কোনো অংশ জেনেশুনে গ্রাস করার গোনাহে লিপ্ত হবে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমানের সম্পদ তার আন্তরিক সম্মতি ছাড়া হস্তগত করলে তা হালাল হবে না।’ (শোয়াবুল ঈমান লিল বায়হাকি : ১৬৭৫৬)।
চাঁদাবাজির ক্ষতিকর দিক : চাঁদাবাজির ক্ষতিকর দিকগুলো অত্যন্ত ব্যাপক। এর প্রভাব ব্যক্তি, সমাজ ও অর্থনীতির ওপর সুদূরপ্রসারী হতে পারে। যেমন- ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সচ্ছলতা বিনষ্ট করে, চাঁদাবাজির শিকার ব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত ভয় ও আতঙ্কে থাকে, তাদের শারীরিক আঘাত বা প্রাণহানির ভয় থাকে, চাঁদাবাজির ভয়ে অনেক ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হন, চাঁদাবাজির কারণে শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়; যা দেশের উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত করে, চাঁদাবাজির কারণে পণ্য পরিবহন ব্যহত হয়।
ফলে বাজারে পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পায়, দুর্নীতিবাজ আমলাদের চাঁদাবাজির কারণে রাষ্ট্রের আয়ের উৎস সংকুচিত হয়। প্রশাসন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক চাঁদাবাজির ফলে রাষ্ট্রে অপরাধ ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। ফলে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়।
ইসলামে চাঁদাবাজির বিধান : ইসলামের শাসনব্যবস্থায় মানুষের জানমাল ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর আইন রয়েছে। ইসলামের নীতিমালায় সরকার, প্রশাসন বা কোনো সংগঠনের পক্ষে ব্যক্তির ওপর অবৈধ চাপ সৃষ্টি করে টাকা আদায়ের সুযোগ নেই। প্রশাসনের কেউ যদি চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত হয়, তাহলে সে আমানতের খেয়ানত করছে। চাঁদা উত্তোলনকারী, ভোগকারী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সরাসরি জালেম অথবা জালেমের সহযোগী। ইহকাল ও পরকালে তারা কঠিন শাস্তির উপযোগী। আল্লাহ বলেন, ‘শুধু তাদের বিরুদ্ধেই (শাস্তির) ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহের আচরণ করে বেড়ায়। বস্তুত তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা শুরা : ৪২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করেছে, সে যেন তার ভাইয়ের পক্ষে তার কাছ থেকে পুণ্য কেটে নেওয়ার আগেই ক্ষমা চেয়ে নেয়। কারণ, সেখানে কোনো দিনার বা দিরহাম পাওয়া যাবে না। তার কাছে যদি পুণ্য না থাকে, তাহলে তার (মজলুম) ভাইয়ের গোনাহ এনে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। (মুসলিম : ১৮৮৫)।
চাঁদাবাজি প্রতিরোধে সমাজের করণীয় : চাঁদাবাজি প্রতিরোধ ও বন্ধ করতে সমন্বিত সামাজিক ও বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। যেমন- চাঁদাবাজির বিরদ্ধে সামাজিক জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, ইসলামি মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার প্রচার ঘটানো, আইনের কঠোর প্রয়োগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা, রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ ও তাদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা, চাঁদাবাজির অপরাধে গ্রেপ্তারকৃতদের জেলখানায় নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং দলমত নির্বিশেষে একতাবদ্ধ হয়ে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার।
চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যাংকখাতের পদক্ষেপ : চাঁদাবাজি বন্ধ করতে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিশেষ কিছু করণীয় রয়েছে। যেমন- চাঁদাবাজির অন্যতম কারণ হলো, বেকারত্ব ও কর্মহীনতা। তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ব্যাংকগুলো সহজ শর্তে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে পারে। বেকারদের কাজে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচি পালন করতে পারে। ব্যাংকের সিএসআর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও বেকারদের জন্য বিভিন্ন কর্মমুখী প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। চাঁদাবাজি যে হারাম ও অবৈধ কাজ, এ বিষয়ে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহক ও সাধারণ মানুষের জন্য সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালাতে পারে। এছাড়া অবৈধ লেনদেন সনাক্ত ও প্রতিরোধে নীতিমালা বাস্তবায়ন করলে চাঁদাবাজদের অর্থ পাচার বা গচ্ছিত রাখা কঠিন হবে।
চাঁদাবাজি থেকে মুক্তির উপায় : চাঁদাবাজি থেকে মুক্তির কিছু কৌশল হলো- ১. ইসলামি শিক্ষার প্রচার করা। কারণ, কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক শিক্ষা সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। ২. আইন প্রয়োগ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং প্রশাসনিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৩. জনগণের মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। ৪. দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। কারণ, ইসলামে অপরাধ প্রতিরোধের অন্যতম পদ্ধতি হচ্ছে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া।
অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া কাম্য : চাঁদাবাজি একটি জঘন্য সামাজিক অপরাধ। ইসলাম এ অপরাধের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে। কোরআন ও হাদিসে এর শাস্তি ও নিন্দা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রসহ সবার উচিত, এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং ইসলামি নৈতিকতা ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। ইসলাম এমন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়, যেখানে কারো ওপর কোনো ধরনের জুলুম বা অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া না হয়। চাঁদাবাজিমুক্ত সমাজ গঠনই ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ ও জীবনব্যবস্থা।