বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাজধানী ঢাকায় নিয়মিত নানা দাবিতে বিক্ষোভ করছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। রিকশাচালক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, শিক্ষক—প্রত্যেকেই কোনো না কোনো কারণে রাজপথে নামছেন। ফলে ধীরে ধীরে ‘বিক্ষোভের শহর’-এ পরিণত হচ্ছে ঢাকা।
প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষের এই শহরে এখন প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো আন্দোলন বা বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছে নগরবাসী, সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ যানজট।
গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তিনি প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেন। সেই থেকে রাজধানী ঢাকায় একের পর এক বিক্ষোভ লেগেই আছে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, তারা গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে।
আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক মনে করেন, এটি গণতান্ত্রিক স্পেস বৃদ্ধির লক্ষণ, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব আন্দোলন সংগঠিত নয়। তিনি বলেন, ‘মানুষ যদি তাদের দাবি-দাওয়া প্রকাশের সুযোগ না পায়, সেটাই হবে বিপজ্জনক।’
অন্যদিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তার শাসনামলে কঠোর শাসনব্যবস্থা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অপহরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ ছিল ব্যাপক। বিশেষ করে ২০০৯ সালের পর থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ব্যাপক দমন-পীড়নের অভিযোগ ওঠে।
সম্প্রতি ঢাকার শাহবাগে এক নজিরবিহীন দৃশ্য দেখা যায়, যেখানে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আহত কয়েক ডজন ব্যক্তি উন্নত চিকিৎসার দাবিতে হাসপাতালের বেড ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন এবং শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরে দীর্ঘদিনের জমে থাকা হতাশাই এখন প্রকাশ পাচ্ছে রাস্তায়। তিনি মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার এখনও এমন একটি পেশাদার ও নৈতিকভাবে শক্তিশালী আইন প্রয়োগ কাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি, যা এই অস্থিরতা সামলাতে পারে।
সরকারের কোনো আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বেসরকারি হিসাবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকায় এখন পর্যন্ত অন্তত ১২০টিরও বেশি বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন একদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অন্যদিকে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করানোর কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। ১৭ কোটি ১০ লাখ মানুষের এই দেশে বছরের শেষ নাগাদ নতুন নির্বাচনের সম্ভাবনাও রয়েছে।
গত মাসে চাকরিচ্যুত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজপথে নামলে পুলিশ লাঠিচার্জ, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে। এক শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। দাবি আদায়ে আন্দোলন ছাড়া আমাদের কোনো পথ নেই।’
এছাড়া, হোটেল-রেস্তোরাঁ, টেলিযোগাযোগ, ওষুধ, কোমল পানীয় ও সিগারেটসহ ১০০টিরও বেশি পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধির প্রতিবাদে ব্যবসায়ীরাও সম্প্রতি বিক্ষোভে অংশ নেন।
একটানা বিক্ষোভে বিরক্ত সাধারণ মানুষও। রাজধানীর বাসিন্দা রওসন আরা বলেন, ‘প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বিক্ষোভ হচ্ছে। রাস্তায় নামলেই যানজট, চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।’
ফেব্রুয়ারির শুরুতে উত্তেজনা চরমে ওঠে, যখন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হামলা চালায় ও ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে বিএনপি। দলটি আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য সরাসরি সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে।
সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল অবশ্য আশাবাদী, এই বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঢেউ সাময়িক। তিনি বলেন, ‘দেশে কার্যকর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে, জনরোষ ও আন্দোলনও স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে।’