ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতি, ধ্বংসস্তূপে ফিরছে মানুষ

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতি, ধ্বংসস্তূপে ফিরছে মানুষ

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিজ ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। এক বছরের ভয়াবহ রক্তপাত ও ধ্বংসযজ্ঞের পর গাজাবাসীর জন্য একটুখানি স্বস্তি এনে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া এ যুদ্ধবিরতি। শনিবার সকাল থেকে গাজার উপকূলীয় সড়ক জুড়ে দেখা গেছে মানুষের স্রোত—কেউ হাঁটছেন, কেউ গাড়িতে, কেউ বা গরুর গাড়িতে চেপে ফিরছেন উত্তর গাজায়, নিজ গৃহের পথে।

আহত কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে পদযাত্রায় অংশ নেয়া নাবিলা বাসাল নামের এক ফিলিস্তিনি বলেন, “এটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না—আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া, আমরা খুবই খুশি যে যুদ্ধ থেমেছে, কষ্টের দিন শেষ হয়েছে।”

জিম্মি বিনিময়

শুক্রবার সন্ধ্যায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। চুক্তি অনুযায়ী, সোমবারের মধ্যে অবশিষ্ট ৪৮ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার কথা রয়েছে হামাসের, যাদের মধ্যে প্রায় ২০ জন জীবিত বলে ধারণা করছে তারা। এর বিনিময়ে ইসরায়েল প্রায় ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

এদিকে ইসরায়েল গাজার প্রায় ৫০ শতাংশ এলাকা প্রতিরক্ষামূলক নিয়ন্ত্রণে রাখার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এক টেলিভিশন ভাষণে তিনি বলেন, “যদি হামাস স্বেচ্ছায় অস্ত্র ত্যাগ করে, সেটাই ভালো। না করলে আমরা কঠোর পথেই তা নিশ্চিত করব। ইসরায়েল গাজার প্রায় ৫০ শতাংশ এলাকা প্রতিরক্ষামূলক নিয়ন্ত্রণে রাখবে।”

সহায়তার অনুমতি পেল জাতিসংঘ

ইসরায়েল জাতিসংঘকে গাজায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার অনুমতি দিয়েছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা জানান, রবিবার থেকেই ১ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি পণ্য গাজায় প্রবেশ করবে। এসব পণ্য ইতোমধ্যে জর্ডান ও মিসরে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। গত কয়েক মাসে গাজায় প্রয়োজনীয় সহায়তার মাত্র ২০ শতাংশ পৌঁছাতে পেরেছিলো বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার।

ধ্বংসস্তূপে ফেরা মানুষদের বেদনা

উপকূলীয় সড়কজুড়ে ভিড় জমেছে হাজারো মানুষের। তারা ফিরছেন উত্তর গাজায়, যেখানে ছিল তাদের বাড়িঘর। কিন্তু এখন চারপাশ জুড়ে শুধু ধ্বংসস্তূপ। গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনী গাজা সিটিতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ চালিয়ে অসংখ্য ভবন ও আবাসিক এলাকা গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

জামাল মেসবাহ নামের একজন ফিলিস্তিনি জানান, “যুদ্ধ থেমেছে শুনে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি, কিন্তু আনন্দ নেই—শুধু বেদনা।”

দক্ষিণের শহর খান ইউনিসে ফিরে আসা ফাতমা রাদওয়ান জানান, “কিছু কাপড়, কাঠের টুকরো আর হাঁড়িপাতিল ছাড়া—বাড়ি বলে কিছু নেই। মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে লাশ তুলছে।”

আরেক বাসিন্দা হানি ওমরান বলেন, “এটা এখন আর কোনো শহর নয়, এটা এক অচেনা ধ্বংসভূমি। চারপাশে শুধু ধ্বংস আর ধুলোবালি।”

এক বছরের ভয়াবহ যুদ্ধের চিত্র

২০২৩ সালে শুরু হওয়ায় ইসরায়েলী ধ্বংসযজ্ঞে এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নিহতদের প্রায় অর্ধেকই নারী ও শিশু। জাতিসংঘ ও স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো এই পরিসংখ্যানকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করেন। এ যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করেছে, বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ সৃষ্টি করেছে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে—যা ইসরায়েল অস্বীকার করেছে।

চুক্তির পরবর্তী ধাপ ও আন্তর্জাতিক ভূমিকা

চুক্তি অনুযায়ী, পাঁচটি সীমান্ত ক্রসিং পুনরায় খোলা হবে, যার মধ্যে রয়েছে মিসর সীমান্তের রাফাহ ক্রসিং। এর ফলে খাদ্য ও ওষুধসহ জরুরি পণ্য পৌঁছাবে গাজায়, যেখানে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য প্রায় ২০০ মার্কিন সেনা ইসরায়েলে পাঠানো হবে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দেবে গাজার পুনর্গঠন কার্যক্রমে, যেখানে আন্তর্জাতিক তহবিল ব্যবহার করা হবে। চুক্তির অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (PA) ভূমিকা রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে, যদিও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। কর্তৃপক্ষকে বড় ধরনের সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যা সম্পূর্ণ হতে সময় লাগতে পারে কয়েক বছর।

এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি শিগগিরই মিসর সফরে যাবেন এবং এ বিষয়ে আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

ভবিষ্যতের প্রশ্ন

বিশ্ব বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধবিরতি যদি টিকে থাকে, তবে তা শুধু গাজার মানুষের জন্য নয়, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত হতে পারে। এই সাময়িক বিরতিকে স্থায়ী শান্তির পথে নিয়ে যেতে হবে কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হলেও, মূল প্রশ্ন এখন—এই যুদ্ধের স্থায়ী সমাধান কোথায়? যদি ন্যায্য রাষ্ট্রীয় অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদার নিশ্চয়তা না মেলে, তাহলে এই শান্তি কেবল বিরতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

ইসরায়েল,হামাস,যুদ্ধবিরতি,ধ্বংসস্তূপ,মানুষ,ফিলিস্তিনি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত