ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আমার মা আমার বেহেস্ত

আমার মা আমার বেহেস্ত

আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। বাড়িতে মা, ছোট বোন এবং শয্যাশায়ী অসুস্থ বাবা। বলে রাখা দরকার আমরা তিন ভাই আর এক বোন। ভাইদের মধ্যে আমি ছোট, আর একমাত্র বোন সবার ছোট, বড় দুই ভাই বিবাহিত। বাবা এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুট মিলে চাকরি করতেন। চাকরিরত অবস্থায় হঠাৎ স্ট্রোক করে ডান পাশ পুরো অবশ (প্যারালাইজড) হয়ে যায়। এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেড় মাস চিকিৎসার পর কোনো উন্নতি না হওয়ায় শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। বাড়িতে দীর্ঘদিন কবিরাজি চিকিৎসা আর মায়ের সেবাযত্নের পর বেশ উন্নতি হয় বাবার। আর আমার বড় ভাই উপজেলা সদরে ব্যবসা করেন। মেজো ভাই ঢাকায় চাকরি করেন। আমি আর আমার ছোট বোন পড়াশোনা করি। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি বড় ভাইয়ের ব্যবসায় সহযোগিতা করি। একদিন আমার বড় ভাই তার শ্বশুড়বাড়ি যাবেন। আমাকে দোকানে থাকতে বলেন। আমি স্কুল থেকে ফিরে দোকানে যাই, আমার বড় ভাই আমাকে দোকানে রেখে শ্বশুরবাড়ি যান। তখন ছিল প্রচুর ঝড়বৃষ্টির দিন, বাড়িতে আমার মা, অসুস্থ বাবা আর ছোট বোন।

আমি যথারীতি দোকানদারি করছি, হঠাৎ সন্ধ্যার পর আমার এক বন্ধু এসে হাজির হলো। সে আমাকে বললো, সিনেমা হলে ভালো ছবি চলছে, দেখবি নাকি? আমি বললাম, বড় ভাই নেই আর এখন তো আটটা বাজে। ছবি দেখে বাড়ি যেতে অনেক রাত হবে। মা ভীষণ রাগ করবেন। ও বললো, কিছু হবে না। তোর মাকে বলবি, এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম।

আমি তার কথায় রাজি হলাম এবং দোকান বন্ধ করে নয়টার শো (রাত নয়টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত) দেখতে গেলাম। টিকিট কেটে হলের ভেতরে ঢুকলাম, ছবি দেখার শেষ পর্যায়ে লক্ষ্য করলাম, বাইরে খুব বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ছবি শেষ হলে বাইরে এসে দেখি, প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বন্ধুকে বললাম, অনেক রাত হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। মা খুব চিন্তা করবেন। বন্ধু বললো, চল রাস্তায় গিয়ে দেখি রিকশা-ভ্যান পাওয়া যায় কি না। রাস্তায় এসে দেখি কোনো ধরনের যানবাহন নেই, কোনো উপায় না পেয়ে দুই বন্ধু ভয়ে ভয়ে হেঁটে রওনা দিলাম। সিনেমা হল থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব এক থেকে দেড় কিলোমিটার হবে।

কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি, পেছন দিক থেকে কোনো বাহনের আলো দেখা যায়। দু’জন মিলে হাত তুলে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোক মোটরসাইকেলওয়ালা ভয়ে ভয়ে বাইক থামিয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমরা বললাম, ভাই খুব বিপদে পড়েছি। আমাদের একটু লিফ্ট দিলে বড় উপকার হতো। উনি বললেন, ভাই আমিও একা একা ভয় পাচ্ছিলাম। তাড়াতাড়ি উঠে বসেন।

এদিকে রাত দশটার পরও যখন আমি বাড়ি ফিরিনি তখন অসুস্থ বাবা আর ছোট বোনকে বাড়িতে রেখে মা আমার খোঁজে বের হন। পাশের বাড়িগুলোতে খোঁজাখুজি করে আমাকে না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়িতে এসে দরজা খুলে তসবি হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। এরপরও যখন আমি বাড়িতে না আসি তখন প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির বাইরে প্রধান রাস্তার অদূরে একটা গাছের আড়ালে। দাঁড়িয়ে থাকেন।

এক পর্যায়ে রাত একটার দিকে মোটরসাইকেল থেকে নেমে বাড়ি যাওয়ার সময় গাছটার কাছে আসতেই একটা আওয়াজ ভেসে আসে, কে বাবু? আমি বলি, কে মা আপনি এই ঝড়ের মধ্যে এখানে কেনো। মা বললেন, তোর জন্য। তুই এখন আসছিস কেনো। এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলি?

আমি কিছু না বলে চুপচাপ ঘরে ঢুকলাম। ঘরে ঢুকে উপলব্ধি করলাম পৃথিবীর সব মা-ই তার সন্তানকে ভালোবাসেন- এটা সঠিক। কিন্তু আমার মার মতো না। গভীর রাতে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে সন্তানের অপেক্ষায় রাস্তার পাশে ক’জন মা দাঁড়িয়ে থাকেন আমি জানি না। এ রকম মমতাময়ী মা পৃথিবীতে আর ক’জন আছেন তা একমাত্র পরম করুণাময় আল্লাহ-ই ভালো জানেন।

আমি ডিগ্রি পরীক্ষা দেয়ার পর হঠাৎ চিকেন পক্সে (জলবসন্ত) আক্রান্ত হই। এক পর্যায়ে আমার সমস্ত শরীর পচে যাওয়ার মতো অবস্থা। দুর্গন্ধে আমার পাশে কেউ আসতে পারে না। ওই অবস্থায় সারারাত তসবি হাতে মা বসে থাকতেন আমার বিছানার পাশে। আমি জানি না, আমার মতো মা আর ক’জনের আছেন।

মা,বেহেস্ত
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত