বাংলাদেশের অর্থনীতি বিগত সরকারের স্বৈরাচারী শাসন,লুটপাট ও অর্থ পাচারের কারণে ভঙ্গুর ও বিপর্যস্ত অবস্থায় পতিত হয়। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার সময় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিনিয়োগ, বেকারত্বের হার ও আমদানি -রপ্তানি প্রভৃতি প্রতিটি খাতই খারাপ অবস্হায় ছিল।
সে অবস্হা থেকে সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে সঠিক নীতি গ্রহনের মাধ্যমে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সূচকের উন্নতি সাধনে সমর্থ হয়েছে বিশেষ করে মুদ্রাস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় এসেছে, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেয়ার পর ও এক্সচেন্জ রেট বাড়েনি, স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ২৭.৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যেও দেশের পণ্য রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। ইপিবি'র তথ্য অনুযায়ী ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৪ হাজার ২১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি।
সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন খাত সংহত হলেও বড় দুশ্চিন্তার বিষয় বিনিয়োগে স্হবিরতা। বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, জ্বালানিসংকট ও উচ্চ সুদ হার সহ প্রভৃতি কারণে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, বিনিয়োগ না বাড়লে অর্থনীতির কোনো অর্জনই টেকসই হবে না। বর্তমান বিনিয়োগ ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, যা আমাদের অর্থনীতির জন্য অন্যতম বড় চ্যালেন্জ।
২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে, বাংলাদেশে মোট ৬,৬৭২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০.৬১ শতাংশ কম।আমদানী প্রবৃদ্ধি হ্রাস অর্থনীতির খারাপ অবস্থা কে নির্দেশ করে। অন্যদিকে বেকারত্বের হার ও বাড়ছে। বিবিএসের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক হিসাবে, গত সেপ্টেম্বর মাস শেষে ২৬ লাখ ৬০ হাজার বেকার আছেন। শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব হার প্রায় ৪০ শতাংশ।
এ সকল চ্যালেন্জ মোকাবেলার জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন করেছে। বিশেষ করে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বিডা বিভিন্ন দেশের উদ্যোক্তাদের নিয়ে বিনিয়োগ সন্মেলন আয়োজন করেছে, ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স উন্নতির চেষ্টা করছে, বিনিয়োগ পরিবেশ ও বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সেবা একটি ডেস্ক থেকে দেয়ার চেষ্টা করছে।
কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ ও বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সামগ্রিক পরিস্হিতির উন্নতি করতে হবে। তাহলেই বাড়তে কাংখিত বিনিয়োগ, যা কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
অর্থনীতির এ সকল চ্যালেন্জের মধ্যে ঈদ -উল-আযহা সমাগত। ঈদ -উল - আযহা মূলত ধর্মীয় উৎসব হলে ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ঈদ উল আযহা উপলক্ষে পশু লালন-পালন, কুরবানির পশু বিক্রি দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে। এ সময় অর্থনীতিতে ব্যাপক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী গরু ও ছাগল কুরবানি হয়েছিল প্রায় ৫৮ লক্ষ । যার বাজার মূল্য প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা।
কুরবানিকৃত পশুর সরবরাহ ও বেচাকেনার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চাঁদা, টোল, বখশিস,ফড়িয়া, দালাল, হাশিল, পশুর হাট ইজারা, রশি ও খুটির ব্যবসা, পশুর খাবার ও পশু কুরবানি ও বানানো এমনকি পশুর সাজগোজের জন্য বিপুল আর্থিক লেনদেন হয়। ফলে অর্থনীতিতে আর্থিক লেনদেন ও মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। তা ছাড়া কুরবানিকৃত পশুর চামড়া বেচাকেনা, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য প্রচুর আর্থিক লেনদেন হয়। পশুর চামড়া রপ্তানি বাণিজ্যে, পাদুকা শিল্প এবং হস্তশিল্পেও ব্যাপক আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। এক তথ্য মতে, দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে সতেরো লাখ ছোট-বড় খামার আছে। এর সঙ্গে প্রায় কোটি মানুষ জড়িত। এরা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করে। এ সময় চামড়া শিল্পে ব্যাংক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। কুরবানির ঈদে পশুর চামড়া সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণ করার সঙ্গে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। এ সময় চামড়া শিল্পে সরকারি ব্যাংকগুলো প্রায় পাঁচ’শ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে থাকে। এতে ব্যাংকের আয় যেমন বাড়ে, তেমনি চামড়া শিল্পের আয়-উন্নতিও বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া এই শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। লবণ চামড়া শিল্পে চামড়া সংরক্ষণের একটি অন্যতম উপাদান। এ জন্য দেশীয় শিল্পে লবণ উৎপাদন এবং চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রয়োজনে আমদানিও বেড়ে যায়। এক হিসেব মতে, গত বছর সরকারকে শুল্কমুক্তভাবে প্রায় চল্লিশ হাজার টন লবণ আমদানি করতে হয়েছে। এর ফলে ব্যবসায়ী, লবণশিল্প এবং পাদুকা শিল্পের আর্থিক তৎপরতা ও কর্মকাণ্ড অনেক বেড়েছে। ঈদ উপলক্ষে প্রতি বছর ফ্রিজের বিক্রি বেড়ে যায়। কুরবানির ঈদকে সমানে রেখে তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকার ফ্রিজ বিক্রি হয় বলে জানা যায়। ফলে এই শিল্পের উৎপাদন ও তৎপরতা অনেক বেড়ে যায়, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ঈদ -উল -আযহায় মশলা বিশেষ করে পিয়াজ,রসুন, আদা, এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা, তেজপাতা কুরবানির সময় উল্লেখযোগ্য হারে ব্যবহৃত হয়। এসব পণ্য অনেকগুলো আমদানি করতে হয়। এসব পণ্য কুরবানির বাজারে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়।
ঈদুল -উল -আযহা উপলক্ষে হজ পালনের প্রস্তুতি, যাতায়াত, আবাসন ব্যবস্থাপনা এবং সৌদিআরবে জীবননির্বাহের জন্য যে খরচ করে তা অর্থনীতিতে একটি বিশেষ অবদান রাখে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে এক লাখ দশ হাজার পাঁচশত ছিয়াত্তর জন মুসলিম হজ পালন করেন। প্রতি জনে গড়ে পাঁচ লাখ টাকা ব্যায় নির্বাহ করলে এই খাতে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া হজের ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাংলাদেশি এবং বিদেশী মুদ্রা ব্যয়ের সংযোগ রয়েছে। এর ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে সেবা এবং লেনদেন বেড়ে যায়। দেশের হজ ও টিকিট অ্যাজেন্সিগুলোর আর্থিক ও ব্যবসায়িক তৎপরতা অনেক বেড়ে যায় এবং সার্বিক অর্থনীতিতে হজের কর্মকাণ্ড গতিশীলতা আনয়ন করে।
আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঈদের সময় ঈদ উপলক্ষে বোনাস প্রদান করা হয়। এক হিসেব মতে, দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারির মধ্যে বোনাস বিতরণ করা হয় প্রায় পনেরো হাজার কোটি টাকা।
দেশব্যাপী ষাট লাখ দোকান কর্মচারিদের বেনাস আসে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। পোশাক ও বস্ত্রখাতের সত্তর লাখ শ্রমিকের সম্ভাব্য বোনাস তিন হাজার পাঁচশত কোটি টাকা। তা ছাড়া আছে বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারির বোনাস। সবমিলে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঈদ উপলক্ষে অর্থনীতিতে বাড়তি যোগ হয়। ফলে অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়। এই অর্থ কিন্তু বসে থাকে না। বরং তা বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যেও গতিকে প্রভাবিত করে। তখন মানুষ জামা-কাপড়, জুতা, প্রশাধনী, আতর ও জায়নামাজ ইত্যাদিসহ নানা খাতে যেমন অর্থ ব্যয় করে. তেমনি গরিব-দুঃখী ও অভাবি মানুষকে দান করার ফলে অর্থনীতিতে অসাধারণ প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়। এ সময় দেশে অধিকাংশ শহুরে মানুষ মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের সাথে ঈদ উদযাপন করার জন্য গ্রামের বাড়িতে ছুটে যায়। ফলে ট্রেন, বাস মালিক সবার ব্যবসায় গতি আসে। এতে কুরবানির সময় পরিবহন খাতে যে বাড়তি চাপ তৈরি হয়, তাতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যবসা ও লেনদেন হয়ে থাকে। এই কর্মকাণ্ডের ফলে অর্থনীতিতে চাকা গতি লাভ করে।
কুরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে প্রবাসী রেমিট্যান্সের প্রবাহ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। প্রবাসীরা তাদের পরিবার-পরিজনের নানাবিধ ঈদ খরচ ও কুরবানির জন্য প্রচুর বিদেশী মুদ্রা পাঠিয়ে থাকে। এতে অর্থনীতিতে লেনদেন বেড়ে যায় এবং জাতীয় অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আগের বছর ঈদের আগের মাস অর্থাৎ মে মাসে যেখানে রেমিট্যান্স আসে ২.২৫ বিলিয়র ডলার। অথচ একই বছর জুন মাসে ঈদ -উল - আযহা পালিত হওয়ার কারণে জুন মাসে মোট রেমিট্যান্স আসে ২.৫৩ বিলিয়ন ডলার।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ নতুন রেকর্ড করেছে। পুরো বছরে মোট রেমিট্যন্স আসে ২৬.৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় তেইশ শতাংশ বেশি। আগস্ট বিপ্লবের পর থেকে প্রতি মাসে দেশে গড়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যায়। ২০২৫ সালে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে তা আগের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি, ফ্রেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসে রেমিট্যান্স দেশে প্রবেশ করে যথাক্রমে ২.১৮ বিলিয়ন, ২.৫৮ বিলিয়ন, ২.৬৩ বিলিয়ন ও ২.৭৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল যথাক্রমে ৩.২৯ বিলিয়ন, ২.৫২ বিলিয়ন, ২.১৮ বিলিয়ন এবং ২.০৪ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল অঙ্কের রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির চাকাকে যেমন সচল করেছে, পতিত সরকারের তলানিতে যাওয়া রিজার্ভকেও শক্তিশালী করছে। তবে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ অনেক বেড়ে যায়।
ঈদ -উল -আযহা অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে ত্বরান্বিত করবে এবং সরকার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চ্যালেন্জ সমূহ কে মোকাবেলা করে হাজারো শহীদ ও প্রায় অর্ধ লক্ষ আহতের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বৈষম্যহীন বাংলাদেশ ২.০ গঠনে সমর্থ হবে।
লেখক: আতিকুর রহমান
আহ্বায়ক, লিয়াজোঁ ও মিডিয়া কমিটি
বৈষম্য বিরোধী সংস্কার পরিষদ-এফবিসিসিআই