অনলাইন সংস্করণ
১২:৫৮, ১৬ আগস্ট, ২০২৫
জ্ঞান যেন আত্মসুখ না হয়, বরং তা হতে হবে সমাজ উন্নয়ন ও মানবিক কল্যাণের হাতিয়ার। আমাদের সমাজে তথাকথিত ‘জ্ঞানী’ মানুষের সংখ্যা বাড়লেও তাদের জ্ঞানে মানবিকতা, সহানুভূতি বা পরিবর্তনের বার্তা কতটা রয়েছে, সে প্রশ্নের উত্তর আমরা কি কেউ খুঁজেছি? আমি যদি আমাকে প্রশ্ন করি, উত্তরের ফল আসবে ‘না’। কিন্তু একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন তার মনের ভাবনার কথা। তার স্নেহাশিস ছেলে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে, পরীক্ষার হল থেকে তাকে আনতে গিয়ে দেখলেন অভিভাবকদ্বয় বলাবলি করছে গোল্ডেন বা এ প্লাস পাওয়া নিয়ে তাদের শঙ্কার কথা। তখনই ওই সাংবাদিক ফেসবুকে এ পোস্টটি দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমার একটু ভাবনার জায়গা তৈরি হওয়া মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ করেছি।
রিকশাওয়ালার কাছে প্রশ্ন : ‘উপকারী জ্ঞান যদি না হয়, আপনি যত বড় বুদ্ধিজীবী হোন, মানুষের কল্যাণ হবে না।’ উত্তরে বলেন, একদম সত্য কথা। সে এমন অঙ্গভঙ্গি দিয়ে উত্তর দিল, মনে হলো সে কোনোদিন এমন সত্যি কথা আর শোনেনি। আমাকে নামিয়ে দেওয়া পর্যন্ত সে বলল, ভাইয়া, ‘হামাক আর যাই কও না কেনে, এইডা একদম সত্য, এটার উপর আর সত্য হয় না।’
মুদি দোকানদারের কাছে প্রশ্ন : মানুষ যন্ত্রের মতো হয়ে উঠেছে। অনুভূতি হ্রাস পাচ্ছে বলে চোখের সামনে রক্তাক্ত সময় দেখেও সহানুভূতিশীল হতে পারে না? উত্তরে বলেন, ঠিক কথা। দাঁত কড়মড় করে চোখগুলো বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, আমার ছেলে মেয়ে দুইটাই সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে কী যে করে, তা বুঝি না। এদিকে আমি বেঁচে আছি না মরে গেলাম-বাসায় যাই বা আসি কোনো কথা নেই। আজ প্রায় এক মাস হলো তাদের সঙ্গে আমার একটি কথাও হয়নি। মনে হয় বাসাটা কেমন মরা মরা। শুধু আমার বাসা না, পথে-ঘাটে সবখানে। কয়েকদিন আগে একটা লোকের অ্যাক্সিডেন্ট হলো এখানে, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে- সবাই তার ছবি তুলছে। কিন্তু তাকে উঠিয়ে যে হাসপাতাল নেবে, সেটাও দেখলাম না, পরে আমরা কয়জন মিলে তাকে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে।
প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হলে বলেন, আমরা যারা রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা ও জনসেবার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের একটাই লক্ষ্য- মানুষের জীবনকে সহজতর, নিরাপদ ও সম্মানজনক করে তোলা। উপকারী জ্ঞান যদি না হয়, আপনি যত বড় বুদ্ধিজীবী হোন, মানুষের কল্যাণ হবে না। তুমি কোথায় যাচ্ছ- এই প্রশ্নটি শুধু একটি দার্শনিক বোধ নয়, এটি প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে জবাবদিহির আহ্বানও। আমরা কি সেই জ্ঞান বা প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনাকে উৎসাহ দিচ্ছি, যা মানুষকে ক্ষমতায়ন করে, নাকি ধীরে ধীরে মানুষের অধিকার ও অংশগ্রহণ হ্রাস করে দিচ্ছি?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে প্রশ্ন : আজকে এআই সভ্যতা চলছে। আমরা তাৎক্ষণিক খুব উৎফুল্ল। প্রযুক্তি-বিপ্লবের প্রতি অন্ধ উল্লাস নয় কি? উত্তরে বলেন, পৃথিবীর দ্রুততর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সবাইকে অগ্রসর হতে হবে। সে আঙ্গিক থেকে এআই আমাদের সময় বাঁচায়, সিদ্ধান্ত নেয়, ছবি আঁকে, গান বানায়, খবর লেখে; কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এতে মানুষের সৃজনশীলতা, সংবেদনশীলতা, পরস্পরের সম্পর্ক কি দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে কিনা? তাও আমাদের দেখতে হবে। তিনিও বললেন, আমরা কি সত্যিই ভাবছি? বিশ্লেষণ করার আমাদের কারও সময়ে নেই, এ কথাটি কেবল একটি নৈতিক বাণী নয়, এটি আজকের সময়ের জন্য এক গভীর আত্মজিজ্ঞাসা। আমরা এমন এক সভ্যতায় বাস করছি, যেখানে জ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ অগ্রগতি আমাদের কতটা মানবিক করে তুলেছে? এ প্রশ্ন আরও জটিল হয়ে পড়ে যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), মেশিন লার্নিং, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, চ্যাটবট-সব মিলিয়ে একটি ‘গ্রাফিক্যাল সমাজ’ গড়ে উঠছে। এ সমাজে বাস্তবতা নয়, বরং তার কৃত্রিম প্রতিচ্ছবিই মূল হয়ে উঠছে। আমরা এখন মুহূর্তের জন্য উচ্ছ্বসিত, কিন্তু ভবিষ্যতের দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি দেখতে পাচ্ছি না।
কারণ আজকের তরুণ প্রজন্ম চ্যাটজিপিটি দিয়ে লেখালেখি করে, গুগলে প্রশ্নের উত্তর খোঁজে, আর ইনস্টাগ্রামে নিজেদের জীবনের edited সংস্করণ তুলে ধরে। এখানে কোনো কিছুই ‘জীবনের মতো’ নয়, বরং ‘জীবনের চেয়ে উত্তম’ বলে মনে হয়। কিন্তু এর মধ্যে আছে এক বিপজ্জনক স্রোত- ১. মানুষ হয়ে উঠছে যন্ত্রনির্ভর, ২. অনুভূতি হয়ে যাচ্ছে সীমিত, ৩. সহানুভূতি হারাচ্ছে প্রাসঙ্গিকতা। যুক্তরাজ্যের Royal Society ২০২২ সালের এক গবেষণায় জানিয়েছে, দীর্ঘ সময় স্ক্রিনে থাকলে মানুষের সহানুভূতিশীল আচরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবার WEF Future of Jobs Report ২০২৪ অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে বিশ্বব্যাপী ৪৪ শতাংশ চাকরি আংশিক বা পুরোপুরি অও দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে। এগুলো নিছক সংখ্যা নয়, এগুলো ভবিষ্যতের মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক পরিণতির পূর্বাভাস।
আজকের পৃথিবীতে যুদ্ধ, নিপীড়ন, বৈষম্য, সবই যেন তথ্য আর ফুটেজে সীমাবদ্ধ। আমরা চোখের সামনে অন্যায় দেখি; কিন্তু আর কিছু অনুভব করি না। ‘ইমোশনাল ফ্যাটিগ’ এখন এক বৈজ্ঞানিক সত্য। একটি প্রজন্ম বাড়ছে, যারা ভয় পায় বাস্তবকে, কিন্তু hours-long স্ক্রলিং-এ ক্লান্ত হয় না। এভাবে সহানুভূতির মৃত্যু হয়। আর যেখানে সহানুভূতি নেই, সেখানে মানুষ যতই স্মার্ট হোক, সে আর মানুষ থাকে না। মানুষের সঙ্গে অন্য প্রাণীর পার্থক্য আসলে তার চিন্তা, শিক্ষা, ও নৈতিক দায়িত্ববোধে। শুধু বেঁচে থাকা নয়, মানুষের জীবনের মর্ম সত্যিই গড়ে ওঠে তার আত্মোন্নয়ন, সমাজের কল্যাণে অবদান এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তারে। প্রাণী যেমন শুধুই স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ করে, মানুষ তাতে যোগ করে জ্ঞান, সংবেদনশীলতা ও পরিকল্পনা। তার শিরদাঁড়া শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও নৈতিক স্তরেও শক্তিশালী হওয়া দরকার।
আমরা সবাই জানি, মানুষ শুধু নিজের জন্য বাঁচে না। প্রাণী যেমন খায়, ঘুমায়, বেঁচে থাকে, ঠিক তেমনই মানুষও। তবে মানুষের জীবনের বিশেষত্ব তার চিন্তাভাবনা, বেড়ে ওঠা ও কর্মে। শুধু পরীক্ষায় ফার্স্ট বা সেকেন্ড হওয়া নয়, উপযুক্ত মানুষ হওয়াই সবচেয়ে বড় অর্জন।
আজকের সমাজে যারা সত্যের পথে চলতে চায়, ভালো থাকতে চায়, তাদের পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি সক্ষম হয়নি। অনেক সময় প্রতিযোগিতা, অবিচার ও সাম্যহীনতার দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। তবুও আমরা পেছনে ফিরে তাকাই না। দিনের চেয়ে দিন ভালো আসবে- এ আশায় আমরা এগিয়ে চলি। আমাদের এ প্রজন্মের বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এসবের দায়িত্ব শুধু ব্যক্তিগত নয়, রাষ্ট্রেরও। সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে আর ওজনে কারচুপি থাকবে না। যার যার পরিমাণ অনুযায়ী সে তার অধিকার পাবে, তার স্বীকৃতি পাবে। একটা সমাজ, যেখানে প্রত্যেকে ন্যায় পাবে, সেখানে মানুষ নিজের পরিচয় খুঁজে পাবে। আর সেই সমাজ গড়ে তুলতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। উপকারী জ্ঞানের সঙ্গে নিজের পরিচয় মেলানো হবে যখন, তখনই সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব।
লেখক : সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার কর্মী; সাধারণ সম্পাদক, সেন্টার ফর বাংলাদেশ থিয়েটার