অনলাইন সংস্করণ
১১:৪১, ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
দেশের বর্তমান পরিস্থিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে সুন্দরভাবে হওয়া নিয়ে সমস্যা দেখছে না বিএনপি। গতকাল রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করে দেশের প্রধান তিনটি দল। বৈঠকে দলগুলো নির্বাচন ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কেউ যদি নির্বাচনের কোনো বিকল্প নিয়ে ভাবে, সেটা হবে এই জাতির জন্য গভীর বিপদজনক।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈঠক শেষে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধিদলের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। তিনি বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন। ফখরুল বলেন, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের আশঙ্কা নির্বাচনকে বিলম্বিত করার লক্ষ্যে একটি চক্রান্ত কাজ করছে। তবে আশঙ্কা করার কারণ নেই। নির্বাচন কমিশন যে সিডিউল ঘোষণা করেছে, সেই সময়ই নির্বাচন হবে। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের সে কথাই বলেছেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা দেশের সবচেয়ে বড় দলের সঙ্গে কথা বলবেন এটি তার এখতিয়ারে রয়েছে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার মধ্যে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে এবং গোটা দেশবাসী আশ্বস্ত হয়েছে।’ গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, রিসেন্টলি যে ঘটনা ঘটেছে, আমাদের রাজনৈতিক নেতা গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে, সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের মতামত নিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলেছি, আমরা মনে করি যে, এটি একটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি, এটি ভালোভাবে তদন্ত হওয়া দরকার।’
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কীভাবে এত বড় নির্বাচন (জাতীয় সংসদ) পরিচালনা করবে, তা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী শঙ্কিত এবং উদ্বিগ্ন। তিনি বলেছেন, আগে একদল বাসস্ট্যান্ড দখলে নিত, এখন আরেকটি গ্রুপ নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে দখলদারদের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় (এখন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন) গতকাল রোববার বিকেলে বৈঠক করে জামায়াতের চার সদস্যের প্রতিনিধিদল। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আযাদ।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো.তাহের বলেন, এখন যে সময় আছে, সরকার যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব। পরিস্থিতির যদি উন্নতি ঘটে, তাহলে একটা নির্বাচন হওয়া সম্ভব।
জামায়াতের এই নেতা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁরা একমত পোষণ করেছেন, তবে কার্যকারিতার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, দেশ একটি নীলনকশার নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সরকারের লন্ডনে একটি দলের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিল, যা একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এতে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং একটি দলকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের দিনে (৫ আগস্ট) নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করাটা কোনো একটা চাপে পড়ে করা হয়েছে। এখানে একটা চাপ আছে। সরকারের উচিত ছিল জুলাই সনদের ব্যাপারে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর নির্বাচনের রোডম্যাপ এবং তারিখ ঘোষণা করা।
জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, নুরুল হকের (গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি) ওপর হামলার ষড়যন্ত্র অনেক গভীরে। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে বলেছে জামায়াত। আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টি কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, জাতীয় পার্টির বিষয়েও একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন তাঁরা।
বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করার বিষয়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে আহ্বান জানানো হয়েছে।
তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে যাওয়ার পরেও আমরা এখনও দেখতে পাচ্ছি, যারা আহত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসন, চিকিৎসা এবং তাদের নিরাপত্তা সেই বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হয়নি। আমরা কিছুদিন আগে দেখেছিলাম শহীদ পরিবাররা তাদের দাবিতে মাঠে নামলে সেখানে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং বেশ কিছু শহীদ পরিবারের সদস্যরা আহত হন। আমরা সরকারের কাছে শহীদ পরিবার এবং আহত সহযোদ্ধা যারা আছেন, তাদের পুনর্বাসন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আহ্বান জানিয়েছি।
আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, গণঅভ্যুত্থানে আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা অংশগ্রহণ করেছেন। সেক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বেশ কিছু লোক আটক হয়েছিল। তাদেরকে বের করতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখনো সেখানে ২৫ জন আইনি জটিলতায় আছেন। সে বিষয়ে যেন সরকার উদ্যোগ নেয় সে বিষয়টিও আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এনসিপির এই নেতা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে একটি গুম কমিশন করা হয়েছে। গতকালকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস ছিল এবং সেই গুম কমিশন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে যে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে এবং প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে আমরা সরকারের কাছে সুস্পষ্টভাবে দাবি করেছি সরকার গুম কমিশনের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে রাষ্ট্রীয় যেসব সংস্থার মধ্যে যেসব সদস্যরা এ ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত, তাদের বিষয়ে যেন সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নেয়।
আরিফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং সাংবিধানিক ভিত্তির জন্য আগামী যে নির্বাচনটি হবে, সে নির্বাচনটি যেন অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচন হয় এবং সে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের দীর্ঘ ৫৫ বা ৫৪ বছরের যে সংকট, যে একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক যে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব কিংবা কাঠামো গড়ে উঠছে, সেটার স্থায়ী সমাধানের জন্য আমরা মনে করি আগামী নির্বাচনটি গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সেটা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে।’
তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়েছে সেই ঘোষণাপত্রে সরকার উল্লেখ করেছে, গত তিনটি নির্বাচনে ফ্যাসিস্ট সরকার এখানে চেপে বসেছিল। ফলে সেই তিনটি অবৈধ নির্বাচনে সরাসরি ফ্যাসিস্টের সহযোগী হিসেবে এবং নির্বাচনকে অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জাতীয় পার্টি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয়, গত নির্বাচনে আপনারা দেখেছেন জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে যে নির্বাচনী প্রচারণা পোস্টারগুলো করা হয়েছে, সেখানে তারা বর্তমান যে জাতীয় পার্টির দুই গ্রুপের যে মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু এবং শামীম হায়দার পাটোয়ারী তাদের পোস্টারের সুস্পষ্ট লেখা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। তার মানে জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যেহেতু রাষ্ট্রীয়ভাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনার জন্য প্রকাশ্যে একটা নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে। নিষিদ্ধ সংগঠনের বিষয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া এবং বিগত সময় অবৈধ সংসদকে বৈধতা দানের তাদের যে পদক্ষেপ সে বিষয়গুলো আমলে নিয়ে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম যেন স্থগিত করার বিষয়ে সরকার আরো বেশি কার্যকর হয়, সে বিষয়টি আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে আমলে নেওয়ার জন্য বলেছি।
আরিফুল ইসলাম আদীবক বলেন, সরাসরি নারীর আসনে নারীদের প্রার্থীর বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করার জন্য তা ১০০ আসনে সরাসরি যেন ভোটের বিষয়টি তারা দেখে। আর ইসির পক্ষ থেকে একটি কথা বলা হয়েছে যে ৩১ অক্টোবরে যাদের বয়স ১৮ হবে, শুধুমাত্র তারা ভোট দিতে পারবে। তার মানে আগামী ছয় মাস পরে যে নির্বাচনটি হবে ওইদিনও যদি কারো বয়স ১৮ হয় সে কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। পরিস্থিতিতে আমাদের এই গণঅভ্যুত্থানে তরুণদের সরাসরি সক্রিয় যে অংশগ্রহণ করেছিল, সেই জায়গা থেকে আমরা মনে করি এটিকে আরেকটু নমনীয় হয়ে ফেব্রুয়ারিতে যাদের ১৮ বছর পূর্ণ হবে, তারাও যেন সরাসরি নির্বাচন অংশগ্রহণ করতে পারে সেই জায়গাটিতে যেন আমলে নেওয়া হয়।