প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৬ আগস্ট, ২০২৫
বারান্দার ওপারে আরেকটি বারান্দা, মানে অ্যাপার্টমেন্টের। এপারে আমার বারান্দা। দুই বারান্দা সমান্তরাল নয়। ওই বারান্দা চারতলায়। এই বারান্দা ছয়তলায়। মাঝে বয়ে গেছে মহল্লার রাস্তা। ওই বারান্দায় সব মিলিয়ে তিন বা চার দিন লোকজন দেখেছি। একদিন দেখি, এক সত্তরোর্ধ্ব লোক ইজিচেয়ারে বসে জাম্বুরা খাচ্ছেন, রোদের তাপ নিচ্ছেন, তখন মনে হয় শীতকাল ছিল। কিন্তু শীতকালে কি জাম্বুরা পাওয়া যায়? আমি কনফিউসড। আরেক দিন দেখি, রাস্তা দিয়ে ‘শিলপাটা, শিলপাটা ফুটা’ বলে যখন এক লোক যাচ্ছিল, তখন এক নারী হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে ওই লোককে ডাকছিলেন। সেটা হবে কোনো এক রমজান মাসে। কারণ, লোকজন ইফতারি কিনে তাড়াহুড়া করে যে যার মতো গন্তব্যে ফিরছিল। আরেক দিন সম্ভবত, না, কিছু মনে পড়ছে না। কারণ, উম্মে গোলাপের সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়ার পরই তাকে আমি একদিন ওই বারান্দায় দেখেছিলাম। ঝড় আসছিল। বর্ষাকাল।
বারান্দার দড়িতে মেলে দেওয়া কাপড়গুলো নিতে এসেছিল। আর বাকি দিনগুলো বারান্দায় কাউকেই দেখিনি। অথচ বাসায় থাকলে আমি বেশির ভাগ সময়ই বারান্দায় কাটাই। বসে থাকি। মানুষের চলাচল দেখি। ছাদের ওপর ডিশ লাইনের তার, ঘড়ি, নির্মাণাধীন ভবনের অনেক অনেক উঁচু তলায় শ্রমিকের মাটি বা ইট তোলা দেখি। এই এলাকা খুব একটা ভালো নয়। কিছু হাইরাইজ ভবন উঠেছে। সস্তায় মানুষ ফ্ল্যাট কিনছে বা বাড়ি ভাড়া করে থাকছে। তবে খুব গাছগাছালি আছে। রাস্তাঘাট একটু বৃষ্টি হলেই ডুবে যায়। আমি ফিরছিলাম এক বিকেলে। সেদিনও বৃষ্টিতে ডোবা রাস্তা। সেদিনই প্রথম পরিচয় উম্মে গোলাপের সঙ্গে। তার এক হাতে কাঁচাবাজারের প্যাকেট, অন্য হাতে ফাইল, কাগজপত্র। এ এলাকায় রাস্তা ডুবে গেলে লোকজন সদর রাস্তা থেকে ১০ টাকা রিকশা ভাড়া ২০ টাকা দিয়ে আসে। কিন্তু উম্মে গোলাপ হেঁটে হেঁটে ফিরছিলেন। শাড়ির নিচটা ভিজে যাচ্ছিল, কিন্তু তুলছিলেন না। খুব হালকা পায়ে এগোচ্ছিলেন। বাসার কাছাকাছি আসতেই তাঁর হাত থেকে ফাইলসমেত কাগজগুলো পড়ে গেল। পড়ার কারণ ছিল, পেছন থেকে ক্রমাগত বেল আর রিকশওয়ালার ‘রিকশা রিকশা...’ আওয়াজ। যেন এক্ষুণি না সরলে তুলে দেবে ওপরে। পরিস্থিতি এমনই। তো, খুব সাধারণ সৌজন্যবোধ থেকে আমি ওনার পানিতে ভিজে যাওয়া ফাইল ও কাগজগুলো কুড়িয়ে দিই। চুপসে গেছে সব। তিনিও সৌজন্যবশত বলেন, ‘আমি উম্মে গোলাপ। সিটি করোনেশন স্কুলে শিক্ষকতা করি।’ এরপর তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের উল্টো দিকের আমার অ্যাপার্টমেন্ট দেখিয়ে বলেন, ‘আপনি তো মনে হয় এই বিল্ডিংয়েই থাকেন!’
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ি। তিনি ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে বিদায় নেন। এসব ঘটনা অন্তত বছর পাঁচণ্ডছয় আগের। এর ভেতর আমি বাসা পাল্টেছি। অন্য শহরেও পোস্টিং হয়েছে। বছর দুয়েকের মাথায় আবার পুরোনো শহরে ফিরেও এসেছি। কিন্তু পুরোনো শহর ভেতরে ভেতরে বদলে গিয়েছিল অনেকখানি। এই যেমন পোস্ট অফিসটা যেখানে ছিল, সেটি প্রায়ই বন্ধ থাকে। কলেজ রোড ধরে ভাড়াউড়ার দিকে এগোলে বাঁ পাশের ভিক্টোরিয়া মাঠে সন্ধ্যার পর কেবলই কয়েকটি বৃত্তে বিড়ির আলো জ্বলে।
চলবে...