প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫
উত্তরবঙ্গে কখনও যাওয়া হয়নি আগে। ইচ্ছার অভাব, নেগেটিভ ভাবনা আর সময়- সব মিলিয়ে কখনও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি। কিন্তু এবার আর তা হলো না। বহুদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে তিন দিনের এক ট্যুর প্ল্যান করলাম; নাটোর, রাজশাহী, নওগাঁ ও বগুড়া ঘিরে। শুক্রবার সকালে ব্যাগ কাঁধে যাত্রা শুরু।
প্রথম দিন : নাটোর
পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ জার্নি শেষে পৌঁছালাম নাটোরে। ছোট্ট, নিরিবিলি এক শহর-তার মধ্যেই যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি। নাটোরের ‘বাংলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত’ সাহিত্যিক জাকির তালুকদারের আন্তরিক আতিথেয়তা পেলাম সেখানে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতেই বেরিয়ে পড়লাম দিঘাপাতিয়ার পথে-গন্তব্য উত্তরা গণভবন।
সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো পুরো চত্বর। মন কাড়ল প্রাচীন দিঘি, হরিণের চিড়িয়াখানা, আর কিছু বিরল বৃক্ষ যা আগে কখনও চোখে পড়েনি। রাজকীয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া যেন চারদিকে। এরপর চা-সিগ্ধ সন্ধ্যায় গেলাম রানীর রাজবাড়ি দেখতে। কারুকার্যে মোড়া স্থাপত্যটি যেন গল্প বলে রাজকীয় সময়ের। দিনশেষে জাকির ভাইয়ের বাসায় রাত্রিযাপন-নাটোরের প্রথম দিনের স্মৃতি রেখে গেল এক প্রশান্ত সন্ধ্যা।
দ্বিতীয় দিন : রাজশাহী
পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় রওনা দিলাম রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। ঘণ্টাখানেকের পথ, কিন্তু দৃশ্যপট যেন ক্রমে বদলে যেতে থাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে ঘুরে দেখলাম প্যারিস রোড, শহীদ মিনার, ক্যাফেটেরিয়া ও বধ্যভূমি। দুপুরে এক ছোট ভাইয়ের বাসায় স্নেহমিশ্রিত আতিথেয়তা শেষে যাত্রা বরেন্দ্র জাদুঘরের পথে।
ইতিহাসের গন্ধে ভরপুর সে জাদুঘর-অমূল্য সব নিদর্শনে ভরা। এরপর গেলাম রাজশাহী কলেজ, তারপর সিএসবি মোড়ে চা-নাস্তা করে টি বাঁধে সন্ধ্যা কাটালাম। পদ্মার তীরে সূর্যাস্তের রঙে রাঙা আকাশ, আর হালকা বাতাসের ছোঁয়া-মুহূর্তগুলো থেকে গেল মনের গহীনে।
রাতে আবার বেরোলাম রাজশাহী শহর ঘুরতে। এক ঘণ্টা ধরে পুরো শহরটিই ঘুরলাম। রাতের খাবার ছিল বিখ্যাত কালাই রুটি আর হাসের মাংশ সাথে চাটনি ও বেগুন ভর্তা।সত্যিই বলতে হয়- রাজশাহী বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন, বাসযোগ্য ও কোলাহলমুক্ত শহর। এখানকার মানুষ, রাস্তাঘাট, আর পরিবেশ- সবকিছুতেই এক শান্ত শৃঙ্খলা।
তৃতীয় দিন : নওগাঁ ও বগুড়া
শেষ দিনের সূচি ছিল বেশ আঁটসাঁট। সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে হোটেল থেকে চেক-আউট করে নাস্তা সেরে রওনা দিলাম নওগাঁর উদ্দেশ্যে। বহু পথ পেরিয়ে পৌঁছালাম ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদে। ১৫৫৮ সালে নির্মিত এই মসজিদটি যেন কালজয়ী। কালো পাথরের দেয়ালে হাত রাখতেই মনে হলো ফিরে গেছি আফগানি শাসনামলের শুর বংশের যুগে।
এরপর রওনা দিলাম পাহাড়পুরের পথে। অষ্টম শতকের শেষ দিকে পাল বংশের শাসনামলে নির্মিত এই সোমপুর বৌদ্ধ বিহার-বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য বিস্ময়। বিশাল স্থাপত্য, নিস্তব্ধ প্রাঙ্গণ আর হাজার বছরের পুরোনো ইটের দেয়াল যেন নিঃশব্দে বলে যায় এক হারানো সভ্যতার গল্প।
পাহাড়পুর থেকে বেরিয়ে যাত্রা বগুড়ার বেহুলার বাসরঘর-এর দিকে। পথে আমার ছোট্ট সঙ্গী জাইন জানতে চাইল,
“পাপ্পা, কেন আমরা একজনের বাসরঘর দেখতে যাচ্ছি? ওদের প্রাইভেসি আছে না?”
তার সরল প্রশ্নে হাসি পেলেও, তাকে বোঝালামণ্ডএ বাসরঘর আসলে এক কিংবদন্তি, এক ইতিহাস। সবুজ প্রাকৃতিক পথে জয়পুরহাট হয়ে পৌঁছালাম সেখানে। সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দির মধ্যে নির্মিত এই স্থাপনাটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে সময়ের সাক্ষী হয়ে।
সবশেষে গেলাম মহাস্থানগড় জাদুঘরে। দুর্ভাগ্যবশত জাদুঘর বন্ধ ছিল, তাই কিছু সময় কাটালাম জাহাজঘাটায়। সন্ধ্যা নামতেই বগুড়া শহরের পথে। বিখ্যাত আকবারিয়া কনফেকশনারিতে দই না খেলে যেন বগুড়া যাওয়া পূর্ণ হয় না- তাই দই খেয়ে অবশেষে রওনা দিলাম ঢাকার পথে।
শেষ কথা
তিন দিনে মোট ১১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দেখেছি বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের জীবন্ত নিদর্শন। নাটোরের নিরিবিলি সৌন্দর্য, রাজশাহীর পরিপাটি নগরজীবন, নওগাঁর প্রাচীন ঐতিহ্য, আর বগুড়ার ঐতিহাসিক গৌরব-সব মিলিয়ে উত্তরবঙ্গ আমার কাছে হয়ে উঠল এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
ঘুরেছি- নাটোরের উত্তরা গণভবন-নাটোরের রাজবাড়ি-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-বরেন্দ্র জাদুঘর-রাজশাহী কলেজ- টি বাঁধ- রাতের রাজশাহী- নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদণ্ড পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার- বগুড়ার বেহুলার বাসরঘর-মহাস্থানগড়-বগুড়া শহর।
বাংলার এই অংশ শুধু ঐতিহ্যবাহীই নয়-এখানকার মানুষ, পরিবেশ ও রাস্তাঘাট আজ সত্যিই উন্নত ও বাসযোগ্য। সুযোগ পেলে আবারও ফিরে যেতে চাই উত্তরবঙ্গের মায়াভরা সেই পথে।