প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০১ নভেম্বর, ২০২৫
বিকেলের উঠানে সবুজ পাতার শৈশব। বিশ্বাসের ছায়ায়-মায়ায় বেড়ে ওঠার উদাস গল্পে ব্যক্তিগত আকুলতা। আকাশের উপকণ্ঠে উজ্জীবিত মায়াবীজ বপনের অপার স্বাধীনতায় রহস্য বাঁধা। রকমারি বাদ্যযন্ত্র আঁচড় কাটে বিষাদের চিহ্ন। অতি গভীর নিমজ্জিত ছায়াচিত্রে নিজেই এঁকে যায় নিজের জীবনচিত্র। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে মানুষ খোঁজে মানুষ। চারদিকে নদীর বিরহগাথায় খুঁজে ফেরে নিজস্ব সত্তা। এতো কিছুর পরও মানুষ অবচেতন প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয়, ভিন্ন আলপনায়। ভোরের জোনাকির সঙ্গে গড়ে সখ্যতা। শিকারি মন নিয়ে ফাঁদপাতা চোখে ভিজে বেড়ায়, রাত-বিরাতে। আড়াল থেকে কেউ একজন বলেছিল তীব্র কণ্ঠে- আসছি। শ্মশান ঘাটে আগুনের লাল শিখায় নতুন কিছু খুঁজে ভয় মিশ্রিত চোখে। এ বেলায় কেটে গেছে অনেকটা সময়। ঘাসপাতার চাদরে বিছানো আগুনের শূন্যতায় শুধুই প্রার্থনা!
দুই. বেশকয়েক মাস পর গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে হাসান। তার দাদা বয়সের ভারে কিছুটা অসুস্থ, এমন খবর পেয়ে তাকে দেখতেই তার গ্রামের বাড়ি যাওয়া। সকাল সাড়ে ৭টায় বাস টার্মিনালে এসে বসে আছে বাসের জন্য। ৮টা ৪০ মিনিটে বাস ছাড়বে। নিদিষ্ট সময়ের আগেই অবশ্য বাসটি চলে আসায় কিছুটা অবাক হয় সে। পূর্বের অভিজ্ঞতা অবশ্য এমন ছিল না। বরাবরই বাস দেরি করে আসে। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা অনেক। তাই আজও হাসান বিলম্ব করে আসতে চেয়েছিল স্টেশনে। কি মনে করে যেন একটু আগেই চলে এসেছে সে। এসে যে ভুল করেনি, সেটাই এখন প্রমাণিত। আগেভাবে এসে এর সুবিধাটুকু পেলো। দ্রুত টিকিট কেটে বাসে বসে পড়েছে মন মতো সিটে। প্রায় ৭০ কিলোর পথ, তাই সামনের সিটে বসে যেতে পারলে ভ্রমণটা আরামদায়ক হয়। জানালার পাশে বসে ভালোই লাগছে তার। মোবাইলে হেডফোন লাগিয়ে পছন্দের গান লাগিয়ে শুনতে থাকে হাসান। চোখ বুঝে ভাবতে থাকে, এভাবে গান শুনতে শুনতে পথটা খুব দ্রুত শেষ হবে।
তিন.
গান শুনতে শুনতে হাসানের মনে এক অদ্ভত ভাবনা আসে, যে ভাবনায় সে কিছুটা বিচলিত হয়ে ওঠে। অসুস্থ দাদার কথা ভাবছে সে। এ যাত্রায় তার দাদা বাঁচবে কি না সন্দেহ। পরক্ষণেই মনে আসে দাদা মরে গিয়ে কোথায় যাবে। মানুষ আসলে কোথায় যায়! এভাবে যাওয়ার যাত্রায় একসময় তার বাবা মারা যাবে, বাবার পর তার সন্তান মানে সে, এভাবে চলতেই থাকবে...। এসব ভাবতে ভাবতে বাসের জানালার কাচ ভেদ করে বাইরে দৃষ্টি যায় তার। আর ভাবতে থাকে- চারপাশে কেউ নেই, রৌদ্রের বিস্ফোরক আনন্দ উদযাপন ফসলের মাঠে। জ্বলে ওঠা সূয্যের তাপে বৃক্ষরাজি আশ্রয়ে বেড়ে উঠছে। ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন উপত্যকায় ক্ষত-বিক্ষত চেনা-অচেনার পথ। সময়ের ভাজে আনন্দ ধূসর স্নিগ্ধ স্মৃতি তার চোখে-মুখে। নগরের রাজপথ ছেড়ে যেনো গায়ে মাখা মাটির গন্ধ মিশে গেছে উর্বর জমিনে।
চার.
হাসান তার নিজস্ব ভাবনা উপত্যকায় বিচরণ করে আরও কিছুক্ষণ। তার অজস্র চিন্তায় নতুন নতুন আগন্তকরা ভাবনার ঘরে আসে। যেখানে ছিন্নমূল পদছায়ায় দুঃখ অনুভব সামান্য সময়ের জন্য। গ্রামের পথে অলৌকিক শব্দহীন কোলাহল সময়ের সুতোয় বাঁধা পড়ে থাকে, বেলা-অবেলায়। ভোর চাহনিতে শিশিরের উৎসব নিঃসঙ্গ ঘাসে। অলস ফসলের একাকিত্ব মনে উষতা খোঁজে। হালকা বাতাসে সমর্পিত ফুল বাগানের প্রতিচ্ছবি মনের গহিনে জাগ্রত হয়ে ওঠে, অজান্তে। এমন ভাবনার মাঝে হাসান ভাবে তার পূর্বপুরুষদের কথা। তার দাদার কথা, দাদার বাবার কথা...। নিজেকে নিজের প্রশ্ন আমার পূর্বপুরুষ কারা। আমার শেকড় কোথায়! হাসান জানে পূর্বপুরুষরা সঠিক হিসেব করে রাখলেও খুব বেশি হলে ছয় বা সাত পুরুষের সন্ধান পাওয়া সম্ভব। এর বেশি নয়। কেউ কি এমন হিসেব করে রাখে বা রাখতে পারে। হয়তো কেউ পারে, কেউ পারে না।
পাঁচ.
হাসান অবশ্য এটাও জানে তার পক্ষে পূর্বপুরুষের শেকড়ের সন্ধানে গিয়ে পৌঁছানে প্রায় অসম্ভব। এখন তো প্রায় অনেক কিছুই সম্ভব। সে ভাবে- প্রকৃতি আর প্রযুক্তির মাঝে মিল কিংবা অমিল দুটোই রয়েছে। যে যার মতো করে প্রকৃতি আর প্রযুক্তি বিষয়ে ব্যাখ্যা করে। অনেকে প্রকৃতির বিরূপ আচরণকে অস্বীকার করে আবার অনেকে প্রযুক্তির চুক্তিও মেনে নিতে আগ্রহী নয়। দুটোই যে মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ তা অন্তত আগ বাড়িয়ে বলা যায়। কিন্তু এমন বাস্তব সত্যকে কেউ মানতে চায় না। এখন গুগুল, ইউটিউব, ফেসবুক যুগ। পৃথিবী সবার নাগালের মধ্যে। যে কোনো বিষয় জানতে চেয়ে গুগুলে আশ্রয় নিলেই হলো- মুহুর্তেই জানিয়ে দেবে সঠিক তথ্য। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রহাম লিঙ্কনের বাবার নাম কি? আপনি জানেন না, কোনো সমস্যা নেই। গুগুলে লিখলেই প্রেসিডেন্ট আব্রহাম লিঙ্কনের বাবা-মার নামসহ পুরো ইতিহাস চলে আসবে। হাসান ভাবে- তার ক্ষেত্রে কি এমন হবে। সে কি এভাবে সব তথ্য পাবে তার পূর্ব-পুরুষদের। নাহ! সে পাবে না। সে কোনো বিখ্যাত লোক নন। গুগুল শুধু বিখ্যাত লোকদেরই স্মরণে রাখে। হাসান ভাবে আর হাসে...। মানুষ কথায় কথায় বলে চৌদ্দ পুরুষের কথা। বাস্তবতা হলো আমরা কেউ আমাদের চৌদ্দ পুরুষের কথা জানি না। কি করতে তারা, কোথায় বা ছিলেন। আদি ধর্মই বা কি ছিল। সর্বোচ্চ পারি চার বা সাত পুরুষের কথা। তিন পুরুষ পর্যন্ত শুধু পরবর্তী জেনারেশন মনে রাখে। মনে রাখে শুধু মৃত্যুবাষির্কী পালনের ক্ষেত্রে। কী অদ্ভুত! অথচ, প্রত্যেক পুরুষ তার পরবর্তী পুরুষদের জন্য জীবনবাজি রেখে সম্পদ গড়ে যায়।
ছয়.
আসলে বাস্তবতার গোলক ধাঁধার অতল স্বপ্নবীজ রোপণ করেও পথমন্ত্রে মনের কপাটে শুধুই দৌড়ানো। এখানে আদিকালের রঙবাহারি অতীত সন্ধানে বহু বছরের একটি দীর্ঘ ছায়াকে স্পর্শ করার চেষ্টা মাত্র। এটা যেন স্পর্শের ছায়াহীন সংসারে অচেনা পথে হেঁটে যাওয়ার কাদামাটির দৃশ্য। যে দৃশ্যের শেষে থাকে দুুদণ্ড অবচেতন সম্পর্কসূত্রের গান। মধ্যআকাশে পান্ডলিপির উদাসীনতায় রচিত পৌরাণিক সৌন্দর্যের গল্প। যেখানে স্বপ্ন নেই, আছে শুধু উপলব্দি। হাসান সেই উপলব্দির গল্পে আবিস্কার করে পূর্ব-পুরুষদের।