ঢাকা রোববার, ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার ফলাফল

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার ফলাফল

গত ২২ এপ্রিল ভারত শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে বন্দুকবাজদের হামলায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে। সীমান্তের একদিকে যেমন সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দাবি জোরালো হয়েছে, তেমনই অন্যপ্রান্তে সমুচিত জবাব দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প নেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, উত্তেজনার সবচেয়ে বিপজ্জনক অধ্যায় পেরিয়ে গেছে কি না? প্রশ্নটি ওঠার কারণ, অতীতে উরি ও পুলওয়ামায় হামলার পর ভারত যে কৌশল অবলম্বন করেছিল; দুই ক্ষেত্রেই ভারত সরকারের নির্দেশে আন্তঃসীমান্ত অভিযান চালানো হয়েছিল। সেই পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ব্যাপক বাড়ে। পুলওয়ামার ঘটনার পর ভারতের তরফে বালাকোটে বিমান হামলা চালানো হয়। এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পাকিস্তান পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। এ আবহে যখন ভারতীয় বিমানবাহিনীর কমপক্ষে একটা বিমান ধ্বংস এবং ভারতীয় পাইলটকে আটক করে পাকিস্তান, তখন দুই দেশের মধ্যে বড়সড় সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল।

প্রসঙ্গত পহেলগামে হামলার জন্য এখনও পর্যন্ত ভারত পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করেনি, যেমনটা অতীতে দেখা গেছে। কিন্তু ভারত সরকার সিন্ধু জল বণ্টন চুক্তি স্থগিত, প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করাসহ একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। যা এ হামলার জন্য ভারত কাকে দায়ী বলে মনে করে, সে বিষয়ে একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। পাশাপাশি ভারত শাসিত কাশ্মীরের অনন্তনাগ পুলিশ এ ঘটনায় সন্দেহভাজন হামলাকারীদের স্কেচ প্রকাশ করেছে। এদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক রয়েছে বলেও অভিযোগ তোলা হয়েছে। তবে প্রমাণের অভাবে প্রথাগত ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতের তরফ থেকে সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে নানারকম জল্পনা-কল্পনা চলছে। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য সেগুলোকে আরও জোরদার করছে।

ভারত-পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি সিদ্ধান্ত : পহেলগামে ২২ এপ্রিল হামলার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা পদক্ষেপ নেয়। সিন্ধু জল বণ্টন চুক্তি স্থগিত করা, ওয়াঘা-আটারি সীমান্ত বন্ধ করা, ভিসা সুবিধা প্রত্যাহার করা এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমিত করাসহ একাধিক সিদ্ধান্ত সেই তালিকায় আছে। এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পাকিস্তানের তরফে সিমলা চুক্তি স্থগিত, সীমান্ত বন্ধ করা, বাণিজ্য স্থগিত, ভারতের ওপর পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ভারতের মতো পাকিস্তানও প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে ও তাদের সহযোগীদের দেশ ছাড়তে এবং কূটনীতিকদের সংখ্যা সীমিত করতে বলেছে। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি ভারতের তরফে নেওয়া সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে। জানানো হয়েছে, ভারত যদি এ চুক্তি থেকে সরে এসে পাকিস্তানের দিকে জলপ্রবাহ বন্ধ করে বা জল অন্যদিকে চালিত করার চেষ্টা করে, তাহলে তা যুদ্ধের পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। পূর্ণ শক্তি দিয়ে এর জবাব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পাকিস্তান। প্রসঙ্গত ১৯৬০ সালের বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে সিন্ধু জল বণ্টন চুক্তি কিন্তু যুদ্ধ, সংকট ও উত্তেজনা সত্ত্বেও বহাল ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ভারতের তরফে এ চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত একটা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে, চাপ সৃষ্টি করতে জলের মতো মৌলিক সম্পদ ব্যবহার করতে প্রস্তুত।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : এ সংকট আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান জানিয়েছেন, ভারত ও পাকিস্তান মারাত্মক সংকটের দিকে যাচ্ছে। পহেলগাম হামলায় বেসামরিক মানুষের মৃত্যু এবং এর জবাবে ভারতের লক্ষণীয় সিদ্ধান্ত, বিশেষত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করা প্রমাণ করে, পরিস্থিতি আর মধ্যস্তরের উত্তেজনায় সীমিত নেই। সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ও থিংক ট্যাঙ্ক স্টিমসন সেন্টারের পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথ থারলকেল্ড বলেন, পহেলগামে হামলার পর সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু তা কখন এবং কীভাবে হবে, স্পষ্ট নয়। ভারতের যেকোনো হামলায় পাকিস্তান অবশ্যই জবাব দেবে এবং দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে, যেখানে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দুই দেশের মধ্যে কারও কাছে পরিষ্কার নাও হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, দুই দেশ যুদ্ধের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, এমন ঘটনা নতুন নয়। গত ২৫ বছরে ভারত-পাকিস্তান বেশ কয়েকবার একেবারে যুদ্ধের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। ২০০১ সালে সংসদে হামলার পর ভারত পাকিস্তানি বিমানের জন্য নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সীমান্তে দুই দেশই নিজেদের বাহিনী মোতায়েন করে। একইভাবে ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পর ব্যাপক উত্তেজনার পর সীমান্তে একই চিত্র দেখা গিয়েছিল। এরপর ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় হামলার জবাবে ভারতীয় বিমানবাহিনী বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ভারতীয় বিমানকে নিশানা করে ভূপাতিত করে এবং বিমানচালককে আটক করে। এত কিছুর পরও প্রচলিত যুদ্ধ বলতে ঠিক যা বোঝায়, তা দেখা যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা : সাম্প্রতিক ঘটনাবলির মধ্যে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত প্রশ্ন উঠেছে, তার মধ্যে একটা হলো- এ পরিস্থিতি প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে কি না। সেসব প্রশ্নের একপ্রকার নিরসন করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, তার বিশ্বাস ভারত-পাকিস্তান নিজেরাই এ পরিস্থিতির সমাধান খুঁজে বের করতে পারবে। ট্রাম্প বলেন, ‘আমি ভারতের খুব কাছের ও পাকিস্তানেরও খুব কাছের।’ পর্যটকদের নিশানা করে চালানো হামলার নিন্দা করে তিনি বলেন, ‘একটা বাজে আক্রমণ (পহেলগামে বন্দুকবাজদের হামলা) হয়েছে।’ কিন্তু এটাও জানিয়েছেন, দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে উত্তেজনা দীর্ঘদিনের। তার কথায়, পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে অনেক উত্তেজনা রয়েছে; কিন্তু এটা বরাবরই ছিল। ভারত ও পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্ব সমাধান খুঁজে বের করতে পারবে বলে তিনি মনে করেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, তারা কোনোভাবে এর একটা সমাধান খুঁজে করবে। আমি দুই দেশের নেতাকেই চিনি।’ তবে ভারত ও পাকিস্তানের সংকটের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে না। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই অনুমান করেছিলেন।

অতীত থেকে শিক্ষা : বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, অতীত থেকে শিক্ষা নিলে দুই দেশের মধ্যে এ সংঘাত ও উত্তেজনা আর বাড়বে না। সাবেক সিনেটর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুশাহিদ হুসেন সৈয়দ বলেন, ‘ভারত অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পুলওয়ামার পরে যখন সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তখন পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া খুব শক্তিশালী ছিল। যা কূটনৈতিক ফ্রন্টে ভারতের ক্ষতি করেছিল। মনে করি, সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকবে ভারত। তারা তাদের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক কার্ড খেলে ফেলেছে।’ আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ আহমের বিলাল সোফি জানান, দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা হয়তো আর বাড়বে না।

আশা করি, ভারতের ঘোষণাগুলো প্রতীকী থাকবে এবং আগামী বছরগুলোতে প্রকৃতপক্ষে জল বন্ধ হবে না। তবে যদি এমনটা করার চেষ্টা করা হয়, তবে তা অবশ্যই প্রথাগত যুদ্ধের দিকে একটা বড় পদক্ষেপ হবে। কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফটের বিশ্লেষক অ্যাডাম ওয়েনস্টেইন বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনো ধরনের প্রথাগত যুদ্ধ বা পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার কারণে যুক্তরাষ্ট্র কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে চিন্তিত। তবে কাশ্মীরে হামলা পরিকল্পিত হোক বা না হোক পশ্চিমা সরকারগুলো ভারতকে পুরোপুরি সমর্থন করার আগে (এ হামলায় বিদেশি উপাদানের জড়িত থাকার বিষয়ে) প্রমাণ চাইবে। তা সে যতই ভারতের প্রতি পশ্চিমাদের সহানুভূতি থাকুক না কেন।’ তার মতে, এসব বিষয়ে লড়াই করতে গিয়ে দুই দেশই তাদের অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য ও সহযোগিতা বাড়ানোর মতো বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করতে পারবে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত