মধ্যযুগে মুসলিম সভ্যতা সারা বিশ্বের জ্ঞানের জগতে বিরাট অবদান রেখেছিল। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পর মুসলমানরা প্রথম বিভিন্ন দেশ জয়ের লক্ষ্যে অভিযান শুরু করেন। পরে তারা বুদ্ধিবৃত্তিচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। শতবর্ষব্যাপী তারা একান্ত বিনয়ের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিকদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করেছেন। এভাবে নিজেদের সমৃদ্ধ করে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় তারা স্বাধীন ও মৌলিক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী আরবদের জ্ঞানচর্চা চলছিল পাঁচশ’ বছর ধরে। এ সময়ই ছিল ইউরোপের ইতিহাসের অন্ধকারতম যুগ। ইউরোপীয় ইতিহাসবিদদের মতে, মধ্যযুগের ইউরোপে বর্বরতা, পশ্চাৎপদতা, বুদ্ধিবৃত্তির স্থবিরতা এমনভাবে গ্রাস করেছিল, তা বর্ণনাতীত। মধ্যযুগ সম্পর্কে স্ট্যানলি লেনপুল বলেন, ‘বহু শতক ধরে মুসলিম মুর শাসিত স্পেনে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার বিরাট ধারা অব্যাহত দেখা গিয়েছিল। শিল্পকলা ও বিজ্ঞান সাধনার জন্য বিরাট কেন্দ্র ছিল। মধ্যযুগে ইউরোপের অন্য কোনো দেশ তখন মুরদের জ্ঞানপিপাসার সমকক্ষ হতে পারেনি।’ হিট্টি লিখেছেন, ‘মধ্যযুগে কর্ডোভা, সেভিল, মালাগা ও গ্রানাডার মতো সুবৃহৎ নগরীতে মুরদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপের গির্জা, মঠকেন্দ্রিক শিক্ষাঙ্গন সৃষ্টির বহু আগে আরব সা¤্রাজ্যের সব বড় বড় শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তরুণ ও প্রতিভাবান মুসলিম শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করত। সেখানে সুকুমার বৃত্তি ও জ্ঞানার্জনের প্রকৃত পরিবেশ ছিল।’
মুসলিম শাসিত স্পেনের শিক্ষানীতি : মুসলিম শাসিত স্পেনের শিক্ষানীতি ছিল উদার। কোনো ধরনের দলান্ধতা শিক্ষার পরিবেশকে কলুষিত করেনি। শিক্ষার ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ ছিল না। মুর শাসিত স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে খ্রিষ্টান ও ইহুদি শিক্ষকরা নির্বিঘ্নে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে অধ্যাপনা করতেন। সব ধর্মের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত ছিল। স্ট্যানলি লেনপুল বলেন, ‘যখন ইংরেজি ভাষার প্রচলন হয়নি এবং যখন লেখাপড়ার মতো গুণাবলি শুধু যাজকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তখনই মুরদের অভূতপূর্ব সভ্যতার কথা জানা যায়। যখন সমগ্র ইউরোপ অজ্ঞতা ও অসভ্য আচার-ব্যবহার দ্বারা নিমগ্ন, বিধর্মী মুররা তখন তাদের প্রতিভার দ্বারা নিখিল বিশ্বকে আলোকিত করে।’
মুসলমানদের শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ : ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর আবু বকর (রা.) খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হয়ে মদিনায় ইসলামি প্রজাতন্ত্রের রাজধানী স্থাপন করেন। ইসলামি সা¤্রাজ্য বিস্তারের জন্য পারস্য ও সিরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। শেষমেষ তা জয় করেন। খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসনকালে ইরাক, পারস্য, সিরিয়া, মিশর, ফিলিস্তিন ইত্যাদি এলাকা ইসলামি সা¤্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। খলিফা ওসমান (রা.) ইসলামি সাম্রাজ্যকে আরও প্রসারিত করার লক্ষ্যে নিশাপুর, বলখ, তুর্কিস্তান ইত্যাদি অঞ্চলে বিজয় অভিযানসম্পন্ন করেন। মাতৃভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশে আরবরা ব্যবসায় ও যুদ্ধে অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। মরুভূমিবাসীর সাহসিকতা ও যুদ্ধপ্রীতির কাহিনি ছিল প্রায় রূপকথার মতো। আরব মুসলমানরা যে নিজেদের যোদ্ধা বলে দাবি করে, তা ইসলামি বিশ্বাস থেকে পাওয়া নয়। ইসলামের সামরিক বিজয় যতটা না আরবীয় নবীর ধর্মীয় শিক্ষার ফল, তার চেয়ে অনেক বেশি যে দেশে এর জন্ম, সেই দেশের সামাজিক পরিবেশের ফলাফল। নবীর আবির্ভাবের আগে আরবরা যত যুদ্ধ করেছে, তা ছিল পরস্পর রক্তক্ষয়ী হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতায় পূর্ণ। ইসলামের নবীর আহ্বানে সেই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। বহুকাল যুদ্ধের নামে যে গৌরব তারা বোধ করেছে এবং নিজেদের মধ্যে যে ভয়াবহ ও কঠিন যুদ্ধ তারা করেছে, অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই সময় তার পরিসমাপ্তি দাবি করেছিল।
জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারে ইসলামের অভ্যুদয় : আরব ব্যবসায়ীদের স্বার্থে প্রথম খলিফা যে অর্থনৈতিক অনুশাসন জারি করলেন, তাতেই সমাজের প্রাচীন ধারায় এলো আমূল পরিবর্তন। ইসলামকে কেবল সামরিক শক্তি হিসেবে দেখলে তা হবে ইতিহাসের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় অন্যায়। মুহাম্মদ (সা.) শুধু আরব যোদ্ধাদেরই নন, তিনি আরব বণিকদেরও নবী ছিলেন। মরুভূমির গোত্রভিত্তিক বিবদমান সমাজে ইসলামের নবী যে ঐক্যের আহ্বান করেছিলেন, আরব বণিকদের জন্য তা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ, শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই ব্যবসার উন্নতি বা সমৃদ্ধি সহজে ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে গোত্রভিত্তিক বিবদমান সমাজে সবার স্বার্থে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা ছিল অপরিহার্য। নবী (সা.) তাই করেছিলেন। তিনি গোত্রভিত্তিক যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য বহু দেবতার জায়গায় আল্লাহর একত্ববাদের ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন। সেজন্য প্রথমেই বণিক সমাজের সমর্থন পেলেন তার একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠায়। যা তাকে দ্রুত সাফল্য এনে দেয়। ইসলামি রাষ্ট্রের বহু নীতি নির্ধারিত হতো আরব ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যের গতি ও স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে। জওহরলাল নেহরু লিখেছেন, ‘ইসলাম ধর্র্মের বিস্তার ও আরবজাতির ক্ষমতালাভের কথা বলার আগে সে সময়ের চারদিকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা দরকার। স্বল্প আগেই রোম নগরীর পতন হয়েছে। গ্রিক-রোমান সভ্যতার চিহ্নমাত্র নেই। একদিকে প্রাচীন সভ্যতা সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে, নতুন সভ্যতারও বিকাশ হয়নি। সুতরাং ইউরোপে তখন অন্ধকার যুগ। ইউরোপের পূর্বপ্রান্তে অবশ্য পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য টিকেছিল। রাজধানী কনস্টানটিনোপল তখন খুব সমৃদ্ধিশালী। ইউরোপের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নগর। জাঁকজমকের সেখানে অন্ত ছিল না। কিন্তু ছিল না জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার। ইউরোপের যখন এ রকম অবস্থা, তখন ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয়।’
মধ্যযুগের বিশ্বে সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা : মদিনায় হিজরত করার ৭ বছরের মধ্যে বিজয়ীবেশে মক্কায় ফিরে এলেন নবীজি (সা.)। নতুন শক্তি সঞ্চয় করলেন মরুজাতির মধ্যে। যখন মুসলমান আরবরা দেশ জয়ে বেরুলেন, অনেক সময় বিনাযুদ্ধেই জয়লাভ করেছেন। রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর ২৫ বছরের মধ্যে আরবরা পারস্য, সিরিয়া, মিশর, আরমেনিয়া ও মধ্য এশিয়া আর আফ্রিকার অনেকাংশ জয় করে নেন। মিশর অতি সহজেই পরাজিত হলো আরবদের কাছে। কারণ, রোমান সাম্রাজ্যের শোষণ ও বিভিন্ন খ্রিষ্টীয় সম্প্রদায়ের বিরোধের ফলে মিশর একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। ফলে জনগণ নতুন কারো শাসনের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিছুদিন আগেও যে আরবরা ছিল যাযাবর, জনগণের বড় অংশই ছিল দরিদ্র আর বিশ্ব রাজনীতিতে ভূখণ্ডটি ছিল অনালোচিত, স্বল্প সময়ে মধ্যযুগের বিশ্বে হয়ে দাঁড়াল বিরাট সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। মুসলমানদের পরপর এসব বিজয় সে যুগের মুসলমান আর অমুসলমান পণ্ডিতদের চমৎকৃত করেছিল।
মুসলমানদের শিক্ষাবিস্তারের ফলাফল : মুসলমানদের সেই সভ্যতার সঙ্গে সমসাময়িক ইউরোপীয় সভ্যতার তুলনা করতে গেলে আশ্চর্য হতে হয়। সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করার বিষয় হলো, আরব মুসলমানরা শুধু বিভিন্ন রাজ্য জয় করেই ক্ষান্ত হননি, প্রত্যেক অঞ্চলের সংস্কৃতি আর জ্ঞান-বিজ্ঞানকে পরম উদারতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের বাস্তব ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ, আরব-অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রমেই বদলে যেতে লাগল। তখনকার নতুন দীক্ষিত মুসলিমণ্ডসমাজেরও সেই পরিবর্তন মেনে নিতে হলো। মরুভূমির বিজেতা আরবরা শুধু ইহুদি-খ্রিষ্টান সম্প্রদায় নয়, নানা জাতির সংস্পর্শে এলো। গ্রিক-রোমক সভ্যতার সমৃদ্ধি ও সুলভ্য পৌর জীবনযাত্রার সৌন্দর্য দেখতে পেল। নতুন ধরনের শহুরে জীবনযাত্রার খোঁজ পেল। এসব শহর ও তাদের জীবনযাত্রার মারফত ইরানি ও ব্যাবলনীয় সভ্যতার দান সম্পর্কে জানতে পারল। বিজয়ী হিসেবে পরে ভারতবর্ষের শিল্প ও বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হলো।
ইসলাম কঠোর পরিশ্রমী হতে শিখিয়েছিল : ইসলাম যাযাবর আরবদের কঠোর পরিশ্রমী হতে শিখিয়েছিল। যাযাবর জীবন শিখিয়েছিল পরিশ্রমই স্বাধীনতার মূলকথা। প্রথম দস্যুবৃত্তি মরুভূমির বেদুইন সমাজে প্রভাব বিস্তার করলেও ধীরে ধীরে ব্যবসাই হয়ে ওঠে স্বাধীন মানুষের জীবিকা অর্জনের লাভজনক ও আকর্ষণীয় পেশা। ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল শ্রমের জয়গান। বাণিজ্য বিকাশের পথকে সুগম করে দিয়েছিল। সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, পারস্য ও ওক্সারের তীরবর্তী অন্যান্য এলাকা জয় করার পর আরবরা দখল করে নেয় চীনের ব্যবসা-বাণিজ্য। সেই সঙ্গে তাদের নিজেদের রাজ্য আফ্রিকা ও স্পেনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপের বাজারের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। অষ্টম শতক থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত একদিকে ভারতবর্ষ ও চীনের সঙ্গে এবং অন্যদিকে ইউরোপের সঙ্গে প্রায় সব বাণিজ্যই করেছে আরবরা। হাজার হাজার বাণিজ্য যাত্রীদল মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে চীন ও ভারতবর্ষের সুদূর প্রান্তসীমা থেকে স্পেন ও মরক্কো পর্যন্ত পথ হেঁটেছে। রাজ্য জয়, ব্যবসা-বাণিজ্যকে ঘিরে আরব সাম্রাজ্যের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার পথ এমনভাবে খুলে গেল, তা আরব জাতির মনে উদারতা, দুনিয়ার মানুষকে আপন করে দেখার সুবুদ্ধি আর সবকিছুকে বিচার-বিবেচনা করে দেখার দৃষ্টিকোণ সৃষ্টি করেছিল। ইসলাম যেমন প্রাচীন সভ্যতার জীর্ণদশাকে ধ্বংস করে সেখানে নিজের অবস্থান করে নিয়েছিল, তেমনি কালক্রমে আরও উন্নততর সমাজব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল। মুসলমানরা সবকিছুর পরও ব্যবসার নীতি বা স্বার্থে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির বিরুদ্ধে ছিল। কট্টর গিবন পর্যন্ত বলেছেন, মুহাম্মদ (সা.) বিনা দ্বিধায় খ্রিষ্টান প্রজাদের ব্যক্তিগত, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের, ধন-সম্পদের নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন তাদের নিজ নিজ উপাসনা করার অধিকার। এ মহৎ সহনশীলতার নীতি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই পালন করা হতো।’
লেখক : গবেষক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী