ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গাজায় নিহতদের গল্প

হুমাইদুল্লাহ তাকরিম
গাজায় নিহতদের গল্প

খাবারের খোঁজে বের হওয়া এক কিশোর, বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের শিবিরে থাকা আট বছরের এক মেয়ে, আর কয়েক মাস অপুষ্টিতে ভোগা এক ব্যক্তি- এরা সবাই গত সপ্তাহে গাজায় মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টিতে আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় বড় আকারের দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ছে বলে সাহায্য সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে। ইসরায়েলি সরকারের এক মুখপাত্র এ দাবি অস্বীকার করে বলেছেন, খাবারের ঘাটতির জন্য হামাস দায়ী এবং তারা ত্রাণ লুট করছে। এদিকে গাজার মানবিক পরিস্থিতি দ্রুত ভেঙে পড়ছে বলে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গাজার অন্তত ১০ শতাংশ মানুষ মারাত্মকভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে।

আবদুল্লাহ জিনদিইয়া : ১৯ বছরের আবদুল্লাহ ওমর জিনদিইয়া ২০ জুলাই খাবারের সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর নিহত হন। তারা মধ্য গাজার আল-সাবরা এলাকায় তাদের মায়ের একটি ভাঙাচোরা বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তার বোন নাদরিন বলেন, ‘সেদিন সে খাবার আনার জন্য খুব অস্থির হয়ে পড়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, ঘরে সামান্য যে ডাল আছে, সেটাই খেয়ে নাও; কিন্তু সে মানেনি।’ বিকেল চারটায় আবদুল্লাহ বাড়ি থেকে বের হয়। পরিবারের জন্য কয়েক কেজি ময়দার বস্তা আনতে সে উত্তরের পথে পাঁচ কিলোমিটার পথ হাঁটে। মূলত সেখানেই সপ্তাহে একবার ত্রাণের ট্রাক আসে। তার সঙ্গে ছিল দুই ভাই এবং কয়েকজন আত্মীয়। রাত ১১টার দিকে এক ভাই মাহমুদ নাদরিনকে ফোন করে জানায়, তারা যখন ত্রাণের ট্রাকের কাছে অপেক্ষা করছিল, তখন হঠাৎ ইসরায়েলি সেনারা তাদের ওপর গুলি চালায়।

ওরা তখন ছিল নেতজারিম করিডর এলাকায়; যা মূলত একটি সামরিক এলাকা। যেটি গাজার উত্তর ও দক্ষিণ অংশকে আলাদা করে রেখেছে। মাহমুদ জানায়, আবদুল্লাহ মারা গেছে এবং তারা আহত হয়েছে। নাদরিন বলেন, আবদুল্লাহ স্থানীয় মুদি দোকানদারদের সঙ্গে কাজ করত। তাদের জন্য ফল ও সবজি বহন করত। তার স্বপ্ন ছিল, যুদ্ধ শেষ হলে নতুন ব্যবসা শুরু করবে। হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা বলেছে, ওদিন গাজাজুড়ে ইসরায়েলি গোলাগুলিতে মোট ৯৩ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও অনেকে। মূলত ত্রাণ বিতরণের পয়েন্টগুলোর কাছে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে।

সেলা মাহমুদ : সেলা মাহমুদের বয়স আট বছর। মঙ্গলবার ভোরে মেয়েটি নিহত হয় বলে জানান তার মা আলা শেহাদা। মা, বড় দুই বোন (যাদের বয়স ১৪ ও ১৩ বছর) এবং এক ছোট ভাইয়ের (বয়স ছয়) সঙ্গে উত্তর গাজার আশ-শাতি এলাকায় বাস্তুচ্যুতদের জন্য একটি শরণার্থী শিবিরে থাকত ছোট্ট এই মেয়েটি। সোমবার সন্ধ্যায় আলা বলেন, বাকি তিন সন্তানকে রেখে তিনি ও তার ১৩ বছরের মেয়ে খাবারের জন্য কয়েক কিলোমিটার দূরের জিকিম সাহায্যকেন্দ্রের দিকে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু রাত প্রায় পৌনে ২টায় তিনি দূরে গোলাগুলির শব্দ শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে যান। তার মনে হতে থাকে, খারাপ কিছু ঘটবে। অপরিচিত কিছু মানুষের সাহায্যে আলা ক্যাম্পে থাকা তার বড় মেয়েকে ফোন করতে সক্ষম হন। তারা নিশ্চিত করে, এরা হামলার শিকার হয়েছে এবং সেলা মারা গেছে। বাকি দুই শিশু বেঁচে আছে, কিন্তু মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। তারা গাজার আশ-শিফা হাসপাতালে আছে।

আহমদ আল-হাসানাত : ৪১ বছর বয়সী আহমদ আল-হাসানাত ২২ জুলাই মারা গেছেন। তার ভাই ইয়াহইয়া আল-হাসানত বলেন, অপুষ্টি তাকে মেরে ফেলেছে। দিন দিন সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। গত মার্চ মাসে ইসরায়েল গাজায় সাহায্য প্রবেশে অবরোধ দেওয়ার পর থেকেই সে অসুস্থ হতে শুরু করে। মে মাস থেকে ইসরায়েল কিছু সাহায্য গাজায় প্রবেশ করতে দিয়েছে। কিন্তু সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, এটা মোটেও যথেষ্ট নয়। আহমদ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। তিন মাস ধরে তিনি পর্যাপ্ত খাবার বা পানীয় পাননি। সামান্য রুটি আর মাঝে মাঝে ক্যান বা কৌটার খাবারের ওপর নির্ভর করতেন। ফলে তার ওজন ৮০ কেজি থেকে কমতে কমতে ৩৫ কেজি হয়ে যায়। স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটে। তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। কখনও কখনও বোঝাই যেত না। আহমদের চাচাতো ভাই রিফাত আল-হাসানাত বলেন, ‘তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডাক্তাররা বলল, তার ওষুধ নয়, খাবার দরকার। তাই আমরা তাকে আবার বাড়ি নিয়ে আসি।’

মুহাম্মদ কুল্লাব : ২৯ বছর বয়সী মুহাম্মদ কুল্লাব ২২ জুলাই এক বিমান হামলায় নিহত হন। তার ভগ্নিপতি রাগাইদা বলেন, পশ্চিম খান ইউনিসের আল-কাদিসিয়া এলাকায় বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জন্য তৈরি একটি ক্যাম্প এলাকায় বিকেল ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে যখন বিমান হামলা হয়, তখন নিজের তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কুল্লাব। তাঁবুতে সে একা ছিল। আমরা শুনেছিলাম, বোমা হামলার কয়েক ঘণ্টা পর কিছু মানুষ তার বোনকে ফোন করে তার মৃত্যুর খবর জানায়। কুল্লাবের মৃত্যুর আগের দিন তার সঙ্গে কথা হয়। ত্রাণের খোঁজে বেরুলে হঠাৎ দেখা হতো। সে আমাকে বলেছিল, একা যেও না; আমি চেষ্টা করব, তোমার জন্য কিছু ময়দা আনতে। পরদিনই সে মারা গেল। কুল্লাব তার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল একটি বোন এবং একটি ছোট ভাই রেখে গেছে। সে ছিল ভদ্র, প্রাণবন্ত একজন তরুণ। কোনো অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে নিজেকে জড়াত না এবং আশপাশের সবাই তাকে ভালোবাসত।

মুহানাদ কাফিনা : ২০ জুলাই ভোরে গাজার শেখ রাদওয়ান এলাকার বাসিন্দা মুহানাদ কাফিনা তার চাচা নাসিমের সঙ্গে খাবারের সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হন। কিন্তু কাফিনা আর ফিরে আসেননি। তিনি সকালে নাসিমকে বলেছিলেন, তার খুব মিষ্টি চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কথা বলার সময় তারা দেখতে পান, একটি খালি ত্রাণবাহী ট্রাক মালামাল আনতে যাচ্ছে। তাই তারা ঠিক করেন, জিকিমের ত্রাণকেন্দ্রে গিয়ে অপেক্ষা করবেন ট্রাকটি ফেরার জন্য। যাতে ট্রাক ফিরে এলে তারা কিছু খাবার পান। কিন্তু নাসিম জানান, তারা যখন পৌঁছান, তখন সেখানে ভিড় ছিল এবং ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালাচ্ছিল। ওই সময় তারা দুজন আলাদা হয়ে যান। নাসিম বাসায় ফিরে ভেবেছিলেন, কাফিনা সেখানে থাকবেন। কিন্তু তিনি ছিলেন না। তারা স্থানীয় হাসপাতালে খুঁজতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত শেখ রাদওয়ানের একটি ক্লিনিকে আরও অনেক অজ্ঞাত লাশের সঙ্গে তার লাশ পাওয়া যায়। নাসিম জানান, তার ভাতিজার মাথায় গুলি করা হয়েছিল। সে একা মারা গেছে। ক্ষুধার্ত আর সাহায্যের আশায় মরিয়া ছিল, যেমন এখন সব গাজাবাসী আছে। তিনি জানান, কাফিনা প্রযুক্তি, সফটওয়্যার আর ইন্টারনেট নিয়ে ভীষণ আগ্রহী ছিল। একদিন ভালো জীবন পাওয়ার জন্য বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখত।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি,গাজা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত