ঢাকা রোববার, ২৪ আগস্ট ২০২৫, ৯ ভাদ্র ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

একঘরে হওয়ার পথে ইসরায়েল

একঘরে হওয়ার পথে ইসরায়েল

গাজায় যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক জনমত ধীরে ধীরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। অনেক দেশ এখন সেই জনমতের প্রতিফলন ঘটিয়ে ইসরায়েলের প্রতি নিন্দাও জানাচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে একাধিক পশ্চিমা দেশ ইসরায়েলের মন্ত্রীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা এক যৌথ বিবৃতিতে গাজায় অসহনীয় মানবিক বিপর্যয়ের নিন্দা জানিয়েছে। চলতি সপ্তাহের শুরুতে গ্লোবাল সাউথভুক্ত কয়েকটি দেশ (সম্মিলিতভাবে ‘দ্য হেগ গ্রুপ’) অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের হামলা রোধে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় একটি ক্যাথলিক গির্জায় ইসরায়েলি হামলার পর ধর্মীয় নেতারাও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। বাড়ছে রাজনৈতিক নেতারা ও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ।

দ্য হেগ গ্রুপের অবস্থান : দ্য হেগ গ্রুপের নিজস্ব ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এটি একটি আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় জোট। এ জোট আন্তর্জাতিক আইন রক্ষা ও ফিলিস্তিনিদের পাশে থাকার লক্ষ্যে ‘সমন্বিত কূটনৈতিক ও আইনি পদক্ষেপ’ নেওয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। এ গ্রুপে আছে আটটি দেশ- দক্ষিণ আফ্রিকা, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, কিউবা, হন্ডুরাস, মালয়েশিয়া, নামিবিয়া ও সেনেগাল। তাদের লক্ষ্য জাতিসংঘ সনদের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আইন, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারসহ সব মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা।

চলতি সপ্তাহেই কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় এ গ্রুপ এক বৈঠক আয়োজন করে। বৈঠকে চীন, স্পেন, কাতারসহ প্রায় ৩০টি দেশ অংশ নেয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রানচেসকা আলবানিজ। এ বৈঠককে ‘গত ২০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অগ্রগতি’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে প্রতিবেদন দেওয়ায় জাতিসংঘের বিশেষ দূত আলবানিজের ওপর সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। দু’দিনের এ সম্মেলন শেষে ১২টি দেশ ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ছয়টি পদক্ষেপের ব্যাপারে সম্মত হয়।

যেসব দেশ ব্যবস্থা নিয়েছে : স্লোভেনিয়া ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থি জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ও চরমপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচকে তাদের ভূখণ্ডে প্রবেশে বাধা দেয়। কারণ, বৃহত্তর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ মোকাবিলায় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর আগে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে এ দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ দুই মন্ত্রী গাজায় অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনের পক্ষে ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি সম্প্রসারণে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। মে মাসে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা যৌথ বিবৃতিতে ইসরায়েলের গাজা অভিযানের নিন্দা জানিয়ে একে ‘সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ বলে আখ্যায়িত করে। ইসরায়েল যদি হামলা বন্ধ না করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে ‘জোরালো পদক্ষেপ’ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়। পরে যুক্তরাজ্য তাদের সতর্কবার্তা অনুসরণ করে কিছু বসতি স্থাপনকারী সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। ইসরায়েলের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য আলোচনায় ‘বিরতি’ ঘোষণা করে। তুরস্কও মে মাসে জানিয়েছে, গাজায় মানবিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ রাখবে।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরও যত সমালোচনা : গাজা শহরের হলি ফ্যামিলি গির্জায় ইসরায়েলের বোমা হামলায় তিনজন নিহত হন। এ কারণে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও নিন্দা জানিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ নিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে এক ‘ক্ষুব্ধ’ ফোনালাপ করেন। এরপর নেতানিয়াহুর কার্যালয় এক বিবৃতিতে এ হামলার জন্য ‘গভীর দুঃখ’ প্রকাশ করেছে। ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত গাজায় ৫৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।

বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের বিরোধিতা : গাজায় ইসরায়েলের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে গণবিক্ষোভ চলছে। যুদ্ধে ইসরায়েলের বর্বরতা ও গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর এর প্রভাব দেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্ষোভ ক্রমে বাড়ছে। পশ্চিম ইউরোপে গত জুনে জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ইউগভের এক জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েলের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নজিরবিহীনভাবে কমে গেছে। চলতি সপ্তাহে মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনে প্রকাশিত একই ধরনের আরেক জরিপে মার্কিনদের মধ্যেও একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে। সেখানে মাত্র ২৩ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, গাজায় ইসরায়েলের পদক্ষেপ ‘সম্পূর্ণ ন্যায্য’। এটি ২০২৩ সালের অক্টোবরে ছিল ৫০ শতাংশ। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বিভিন্ন সংগীত উৎসবেও ছড়িয়ে পড়েছে।

ইসরায়েলের ভেতর যে পরিবর্তন হচ্ছে : গাজার যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ এখনও ছোট আকারে আছে, কিন্তু বাড়ছে। ‘স্ট্যান্ডিং টুগেদার’ নামের একটি সংগঠন ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি নাগরিকদের একত্র করে আন্দোলন করছে। গত এপ্রিলে ইসরায়েলি সাময়িকী +৯৭২ (প্লাস নাইন সেভেন টু)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক লাখের বেশি ইসরায়েলি রিজার্ভ সেনা দায়িত্ব পালন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেনাবাহিনীর ভেতর থেকেও খোলাচিঠির মাধ্যমে যুদ্ধবিরোধী বার্তা দেওয়া হচ্ছে।

ফলাফল যা হতে পারে : দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অজনপ্রিয় হলেও নেতানিয়াহুর কট্টরপন্থি জোট সরকার গাজায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের সর্বশেষ প্রস্তাবে গাজার সব মানুষকে একটি তথাকথিত ‘মানবিক শহরে’ আটকে রাখার পরিকল্পনা করা হয়। অনেকেই এ পরিকল্পনাকে একটি ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন।

ইসরায়েল যে আন্তর্জাতিক আইন বা বিশ্ব মতামতের কোনো পরোয়া করে না, এটিকে তার প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন অনেক সমালোচক। আন্তর্জাতিকভাবে গাজার একমাত্র ক্যাথলিক গির্জায় বোমা হামলার জন্য সাম্প্রতিক সমালোচনা সত্ত্বেও ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থন এখনও দৃঢ়। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এখনও ইসরায়েলের প্রধান কূটনৈতিক ভরসা। ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্য জাতিসংঘে ভেটো দেয়, সামরিক সাহায্য জোগায় ও ইসরায়েলের সমালোচকদের (যেমন- আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত- আইসিসি) ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যুক্তরাষ্ট্রের এ সমর্থন ইসরায়েলকে আপাতত রক্ষা করছে; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন আন্তর্জাতিকভাবে ইসরায়েল একঘরে হয়ে পড়বে, তখন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা মোকাবিলা করা তার জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

সূত্র : আল-জাজিরা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত