
দেশের প্রথম কঙ্কাল জাদুঘর (অ্যানাটমি মিউজিয়াম) গড়ে তোলা হয়েছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু)। এর যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে। বর্তমানে তা দৃশ্যমান রুপ নিয়েছে। এখানকার ইউসুফ চৌধুরী ভবনের নিচতলায় ৩ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে এই জাদুঘরের অবস্থান। মিউজিয়াম পরিদর্শনে গিয়ে প্রথমে মনে হবে এক কঙ্কালপুরি। চারদিকে বিভিন্ন প্রাণীর অস্থি। কোথাও শুয়ে আছে সাপ, কোথাও কুমির। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে জিরাফ ও উট। চোখের পলক ফেলতেই দেখা মেলে হাতির। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচ্চশিক্ষা ও মানোন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় জাদুঘরটি স্থাপন করা হয়েছে। সিভাসুর অ্যানাটমি ও হিস্টোলজি বিভাগের শিক্ষক ও বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ লুৎফুর রহমানের ব্যবস্থাপনায় বিভাগের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখানে বিভিন্ন প্রাণীর কঙ্কাল সাজিয়েছেন সুনিপুণভাবে।
কঙ্কাল জাদুঘরে বিভিন্ন প্রাণীর প্রায় ৬০টি কঙ্কাল, ৩০টি স্ট্যাফ (প্রাণীর অস্থি থেকে চামড়া আলাদা করে নতুন অবয়ব সৃষ্টির পর পুনরায় চামড়া দিয়ে মোড়ানো), রাসায়নিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত বিভিন্ন প্রাণীর প্রায় ৫০০ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও দুই হাজার অস্থি, ৭৫টি বিভিন্ন প্রাণীর মডেল ও ৩ হাজার স্লাইড রয়েছে। স্টাফিং করা প্রাণীর মধ্যে আছে- মোরগ, মুরগি, রাজহংসী, কবুতর, কাঠঠোকরা, দোয়েল, পেঁচা, মাছরাঙা, কোয়েল, খরগোশ, গিনিপিগ, কচ্ছপ, অজগর, কোবরা, বাদুড়, হাঁস। কঙ্কাল জাদুঘরে আরও আছে মানবদেহ, মানুষের চোখ, হৃদপি-, জরায়ু, ফুসফুস, কিডনি, স্তন, কুকুর, বিড়াল, শুকর, গাভি ও মুরগির ডিএনএ, ক্রোমোজোম, ছাগল-শুকর ও খরগোশের ভ্রুণ। ফরমালিন দিয়ে এসব অঙ্গ সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই জাদুঘরের প্রবেশপথে বসানো হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা থেকে সংগ্রহ করা জিরাফের কঙ্কাল। ২০১৯ সালে মারা যাওয়া জিরাফটির অস্থি ছয় মাস পর কবর থেকে তুলে বিশেষ ব্যবস্থায় চট্টগ্রামে এনে বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে অ্যানাটমি বিভাগে সংরক্ষণ করা হয়। জানা যায়, প্রতিটি অস্থি প্রায় দেড় বছর ধরে জোড়া দিয়ে জিরাফের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কঙ্কাল আনা থেকে সংরক্ষণ ও জোড়া লাগাতে খরচ হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশে জিরাফের কঙ্কাল নেই। ৩য় কঙ্কালটি স্থাপিত হলো সিভাসুতে। এছাড়া হাতির কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয়েছে কক্সবাজারের চকরিয়ায় অবস্থিত সাফারি পার্ক থেকে। সুউচ্চ উটের কঙ্কাল এসেছে ঢাকার চিড়িয়াখানা থেকে। বিশাল অজগর সাপটি মৃত অবস্থায় সংগ্রহ করা হয়েছে সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক থেকে। বড় কুমিরের কঙ্কাল আনা হয়েছে ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত কুমির প্রজনন কেন্দ্র থেকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাণীর দেহ স্টাফিং করার ধারণা এসেছে প্রাচীন মিশরের মমি থেকে। যদিও মমি ও স্টাফিং এক বিষয় নয়।
মধ্যযুগে জ্যোতিষী, ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী প্রস্তুতকারক এবং বিক্রেতারা বিভিন্ন মৃত প্রাণীর স্টাফিং করে রাখত। ১৭৪৮ সালে ফ্রান্সের রওমার অঞ্চলে প্রাকৃতিক ইতিহাসের অ্যানসাইক্লোপিডিয়ার স্টাফিং পদ্ধতিতে পাখি সংরক্ষণের কথা জানা যায়। ফ্রান্স, জার্মানি, ডেনমার্ক ও ইংল্যান্ডে তখন এই পদ্ধতিতে পশু-পাখি ও জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা হতো। ১৮৩৭ সালে ভিক্টোরিয়া যুগ শুরু হলে স্টাফিং জনপ্রিয় শিল্পে রূপ নেয়। তখন পশু-পাখির স্টাফিং দিয়ে ঘর সাজানো হতো। ১৮৫১ সালে লন্ডনের হাইড পার্কের প্রদর্শনীতে বেশ কয়েক প্রকার পাখির স্টাফিংও ছিল। সিভাসুতে মৃত প্রাণীর চামড়া ছাড়িয়ে ট্যানারির মতো বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পরিষ্কার করে তুলা, রড ও জিআই তার দিয়ে অবয়ব (স্টাফিং) বহাল রাখা হয়েছে। দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও তন্ত্রের চিত্র এবং জীববিজ্ঞান ও প্রাণিবিদ্যায় অবদান রাখা বিজ্ঞানীদের পোট্রেট।
কঙ্কাল জাদুঘরটি আরও সমৃদ্ধ করতে অ্যানাটমি বিভাগ সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। কঙ্কাল জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান বলেন, এখানে বিভিন্ন গৃহপালিত এবং বন্য প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করে রাখার ফলে শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক ক্লাসে হাতে-কলমে শিখতে পারছে। প্রাণীদেহের অঙ্গ ও তন্ত্রের অবস্থান, গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং কাজ সম্পর্কে শিক্ষাদান করাই আমাদের মূল উদ্দেশ। সর্বশেষ জিরাফের কঙ্কাল স্থাপনের মাধ্যমে এই জাদুঘর সমৃদ্ধ হয়েছে। দেশের শিক্ষার্থীদের ভেটেরিনারি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরির পাশাপাশি এই পেশার সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে কঙ্কাল জাদুঘর বিশেষ ভূমিকা রাখবে। সিভাসুর জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরের সিনিয়র উপ-পরিচালক খলিলুর রহমান জানান, এ মিউজিয়ামটি আমাদের সক্ষমতা জানান দেয়। বাংলাদেশের প্রথম এই অ্যানাটমি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে জিরাফ, হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, কুমিরসহ বিভিন্ন প্রাণী ও পাখির ৩০০টি কঙ্কাল এবং ২০০টি মডেল। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা অ্যাকাডেমিক শিক্ষার অংশ হিসেবে এই মিউজিয়াম পরিদর্শন করতে আসেন।